ঢাকা, রবিবার, ৬ অক্টোবর ২০২৪ | ২১ আশ্বিন ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ব্যাখ্যা আছে সমাধান নেই

ধানের মূল্যবঞ্চিত কৃষক

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:১৩ অপরাহ্ণ, মে ১৯, ২০১৯

রেকর্ড ফলনের পরও ধানের দাম না পাওয়া লাখো কৃষকের কান্না শুনছে গোটা দেশ। যেখানে মণপ্রতি ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা সেখানে বাজারে ধানের দাম উঠছে মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। বাজারের এ অবস্থা দেখে মজুর খাটিয়ে ধান কেটে ঘরে তোলার সাহসই করছেন না অনেক কৃষক। কেউ কেউ রাগে দুঃখে ক্ষোভে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছেন নিজের ফলানো ধানে। সর্বস্বান্ত কৃষকদের এ অবস্থা দেখার পরও নির্বিকার সরকার। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-এমপি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সমস্যার নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তুলে ধরলেও সমাধানের পথে হাঁটছেন না কেউ।

এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে প্রায় দুই কোটি মেট্রিক টনেরও বেশি ধান উৎপাদিত হয়েছে সারা দেশে। কিন্তু মজুদ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় গলদের কারণে ধানের ন্যায্যদাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক। ভুক্তভোগী কৃষকদের ভাষ্য, সরকার মধ্যস্বত্বভোগী রাইস মিল মালিক, ব্যাপারী ও ফড়িয়াদের হাতে চালের বাজার ছেড়ে দিয়েছে। ফলে অতি মুনাফালোভী ব্যাপারী, আড়তদার, মোকাম মালিকরাই এখন চালের বাজারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রক। মাঠে ঘাম ঝরিয়ে ধান ফলিয়ে সে ধানের বাজারে কৃষকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে রয়েছে সারা দেশের কৃষক। তারা বলছেন, সার, বীজ, কীটনাশক, ডিজেল, বিদ্যুৎ, শ্যালোমেশিন, পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, ডিপ টিউবওয়েল, ধান মাড়াই যন্ত্রসহ কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতির দাম বেশি হওয়ায় ধানের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে অথচ ধানের দাম বাড়ছে না। অপরদিকে ধানের দাম না বাড়লেও চালের দাম ঠিকই বছরে দু-তিন দফায় বাড়ছে। ভোক্তা পর্যায়ে চালের দাম বৃদ্ধি হলেও এর কোনো সুবিধা উৎপাদক পর্যায় অর্থাৎ কৃষক পাচ্ছেন না।

চলতি অর্থবছরে আউশ, আমন ও বোরো মিলিয়ে মোট তিন কোটি ৬৪ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকার। এর মধ্যে আউশ ২৭ লাখ টন, আমন ১ কোটি ৪১ লাখ টন এবং বোরো ১ কোটি ৯৬ লাখ টন। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ২৯ লাখ ২০ হাজার টন আউশ ও ১ কোটি ৪৩ লাখ টন আমন চাল উৎপাদিত হয়েছে। শেষে বোরো উৎপাদিত হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ লাখ টন বেশি।
এর মধ্যে সরকার গত মার্চ মাসের শেষের দিকে মাত্র ১৩ লাখ মেট্রিক টন ধান-চাল কিনবে বলে জানায়। যেখানে প্রতি কেজি ধান ২৬ টাকা, সিদ্ধ চাল ৩৬ টাকা, আতব চাল ৩৫ টাকা দাম ধরা হয়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে সরকারের ক্রয়কেন্দ্র না থাকায় সরকার এসব চাল কিনছে চালকল মালিকদের কাছ থেকে। আর চালকল মালিকরা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনছে কেজিপ্রতি মাত্র ১০-১২ টাকা দরে। ফলে সরকারের এ উদ্যোগের পূর্ণ সুফল ভোগ করছেন মিল মালিক ও ফড়িয়া মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা।

এদিকে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে চালের উৎপাদন হলেও সে চাল সংরক্ষণ বা মজুদের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি সরকার। সরকারি গুদামে ধান-চাল মজুদ সক্ষমতা রয়েছে ২০ থেকে ২২ লাখ টন। এর মধ্যে এখন মজুদ আছে ১৩ লাখ টন। ফলে নতুন উৎপাদিত দুই কোটি টন ধানের কেনাবেচা বা এর ব্যবস্থাপনা কীভাবে করা হবে তা নিয়ে বিপত্তি দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ করে রপ্তানির কথা তুলেছেন। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে চালের চাহিদা যেমন কম তেমনি দামও কম। এ অবস্থায় দেশে চালের আমদানিও অব্যাহত রয়েছে। ফলে ধান-চালের ন্যায্যদাম পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখছেন না কৃষক।

এর মধ্যে অবশ্য গতকাল কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেই দিয়েছেন, এ মুহূর্তে ধানের দাম বাড়ানো খুবই কঠিন। এবার তাদের কিছুটা ক্ষতি হবে। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, সমস্যা থেকে উত্তরণে ধান রপ্তানির মতো ভিন্ন কিছু উপায়ের কথা তারা বিবেচনা করছেন। এতে ধানের দামের ওপর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন তিনি। ধান কাটা শেষ হলেই ফসলের পরিমাণ দেখে তারা রপ্তানির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন বলেও জানান মন্ত্রী।

এদিকে, দেশের কৃষক বাঁচাতে অবিলম্বে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কোনো অজুহাত শোনা হবে না। সরকার নির্ধারিত মূল্যে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা এবং প্রয়োজনে অর্ধেক দাম আগাম দিয়ে কৃষকের গোলায় ধান রাখা ও সরকারি গুদামে সরবরাহের পর বাকি অর্ধেক দাম পরিশোধ করার পদ্ধতি চালুর দাবি করেন তিনি।
সরকারি গুদাম খালি না থাকলে বেসরকারি ও ব্যক্তিখাতের গুদাম ভাড়া নিয়ে সরকারিভাবে ধান সংরক্ষণের কথা বলেন ইনু। সে সঙ্গে এই মুহূর্তে চাল আমদানি বন্ধ রাখার দাবিও জানান।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অবস্থা বিবেচনা করে জানিয়েছেন, ‘দেশের কৃষকদের বাঁচাতে চাল আমদানি বন্ধ করা হবে এবং ভর্তুকি দিয়ে হলেও চাল রপ্তানি করা হবে।’ কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ ২০১৯-২০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণার আগে কৃষি ও এর উপখাতগুলোতে সরকারের বরাদ্দ ও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে কিছু সুপারিশ দেন। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়েই অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ বছর দেশে লক্ষণীয়ভাবে অনেক বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে। বিষয়টি শুধু আমাদের বেলায়ই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে। সে কারণে দেশের বাইরে খাদ্যশস্যের চাহিদা কম। সেখানে ডিমান্ড থাকলে আমরা রপ্তানি করতাম।’
তাই মন্ত্রী এ বছর আমদানির চেয়ে চাল রপ্তানি করার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে জানান। তিনি সবজির মতো চালও ভর্তুকি দিয়ে রপ্তানি করা হবে বলে জানান।

তবে এসব উদ্যোগকে কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যদাম পাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট বলে মনে করছেন না কৃষক ও ক্ষেত-মজুর আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতারা। তারা বলছেন, দেশের সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থানের খাত কৃষি। কিন্তু কৃষিখাতে সুনজর নেই সরকারের। নেই কৃষিবান্ধব নীতি। দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে কৃষিঋণ ব্যবস্থাপনা। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, খরাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের নিরাপত্তা বা কৃষকের জন্য বীমা সুবিধাও নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। এত সব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ফসলের বাম্পার ফলনে পিছিয়ে নেই কৃষক। সরকারের কার্যকর কৃষিনীতি না থাকার কারণে কৃষক আজ দিশেহারা। কৃষি খাতকে শতভাগ বাজারে ছেড়ে দিলে এ সমস্যার মধ্যেই কৃষককে ঘুরপাক খেতে হবে। সে জন্য বাজারে ছেড়ে না দিয়ে কৃষির প্রতি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে হবে। কৃষিতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ চালু করতে হবে। তাতে ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট যেমন থাকবে না তেমনি আমাদের খাদ্যের মূল উৎস কৃষি খাতের শ্রমিক ও উদ্যোক্তা বা কৃষকও ভালো থাকবে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম খোলা কাগজকে বলেন, বর্তমান অবস্থা থেকে কৃষককে বাঁচাতে হলে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতে হবে সরকারকে। এ জন্য প্রয়োজনে ওয়ার্ড পর্যায়ে, সম্ভব না হলে ইউনিয়ন পর্যায়ে ক্রয়কেন্দ্র চালু করে ধান সংগ্রহ করতে হবে। কোনো রকম কারসাজি বা ‘কমিশন’ খাওয়া বা চাঁদাবাজির সুযোগ যেন কেউ না পায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। সরকার উৎপাদিত ধানের খুবই ক্ষুদ্র অংশ কিনছে। কৃষকের বদলে ‘চাল ক্রয় কার্যক্রমের’ গোটা সুবিধা নিচ্ছে বিত্তবান রাইস মিল মালিকরা। ব্যাপারী, আড়তদার, মোকাম মালিকদের একচেটিয়া-কারবারি সিন্ডিকেট গোটা ধান-চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে তাদের কাছে কৃষকরা জিম্মি। এ জন্য বাজারের ওপর সরকারি বা সমবায়িক নিয়ন্ত্রণ চালু করতে হবে। সেই সঙ্গে কৃষি উপকরণের দাম কমিয়ে ধানের উৎপাদন খরচও কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এরপরও বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থাপনা বা সরকারি কাঠামোতে কৃষকের বঞ্চনার অবসান ঘটবে তা নয়, কৃষকের বঞ্চনার অবসান ঘটাতে হলে প্রয়োজন কৃষি ব্যবস্থা ও গ্রাম-জীবনের আমূল বিপ্লবী পুনর্গঠন দরকার।

আমদানি সীমিত হবে : আ হ ম মুস্তফা কামাল
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘দেশের কৃষকদের বাঁচানোর জন্য চাল আমদানি সীমিত করা হবে।’ গতকাল রোববার আসন্ন বাজেট নিয়ে ‘আগামী বাজেটে কৃষকের পক্ষে শাইখ সিরাজের সুপারিশমালা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ কথা জানান তিনি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সম্মেলন কক্ষে এ আলোচনা অনুষ্ঠান হয়।
বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের কৃষকদের স্বার্থে আমরা অবশ্যই আমদানি রেস্ট্রিক্টেড করব। কিন্তু আমরা তো এটা (রপ্তানি) ব্যান করে দিতে পারব না।’
এ বছর বোরো ধান আবাদ করে উৎপাদন খরচ উঠছে না বলে সারা দেশে কৃষকদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে। ধানের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় এ সমস্যা দেখা দিয়েছে দাবি করে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক গত শনিবার বলেছিলেন, উদ্বৃত্ত ফসল রপ্তানি করে এই সংকটের আপাত সমাধান সম্ভব। তবে চালের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, ‘বাইরে যদি ডিমান্ড থাকত, আমরা রপ্তানি করতাম। বাইরেও চাহিদা নেই।’

ভবিষ্যতে কৃষির উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য কৃষকের আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, ‘এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে কৃষক উপকৃত হবেন। এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে উৎপাদন বাড়বে, খরচ কমবে।’

ভর্তুকি দিয়ে সবজি রপ্তানিতে সাফল্য দেখিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এক সময় সবজিতেও এরকম হচ্ছিল। কৃষকরা দাম পাচ্ছিল না। আমরা ভর্তুকি দিয়ে রপ্তানির ব্যবস্থা করলাম। এরপর সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন চার নম্বরে। রপ্তানির বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। সবজিতে অন্তত দামটা পাচ্ছেন কৃষক। প্রয়োজনে চালেও ভর্তুকি দিয়ে রপ্তানি করতে পারি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করব।

উৎপাদন খরচ না পেলে কৃষকরা উৎসাহ হারাবেন- স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এগুলোর সমাধান করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। আমার মন্ত্রণালয় থেকে যা যা করা দরকার, সেগুলোর প্রতিফলন আপনারা (বাজেটে) দেখতে পাবেন।’

কৃষকদের এবার কিছুটা ক্ষতি হবেই : ড. আবদুর রাজ্জাক
দেশে ধানের ফলন ওঠার মৌসুমে দাম অস্বাভাবিকহারে কমেছে। উৎপাদন খরচের তুলনায় দাম অনেক কম। ধানের দাম কমায় কৃষকদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। যে কারণে কৃষকরা ধানে আগুন লাগিয়ে বা রাস্তায় ধান ঢেলে নানা অভিনব কায়দায় প্রতিবাদও জানিয়েছেন। পাশাপাশি দাবি করেছেন ধানের ন্যায্যমূল্যের।
এই প্রেক্ষাপটে সরকারের কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘এ মুহূর্তে ধানের দাম বাড়ানো খুবই কঠিন। তবে ধান রপ্তানির মতো ভিন্ন কিছু উপায়ের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। এতে ধানের দামের ওপর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’ বিবিসি বাংলা অনলাইনের এক প্রতিবেদনে এসব কথা জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী।

ড. আবদুর রাজ্জাক ধানের দাম কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলেন, ‘আমরা বলছি যে ধানের উৎপাদন এবার আশাতীতভাবে বেশি হয়েছে। আমাদের টার্গেট ছিল এক কোটি চল্লিশ লাখ টন। এক্ষেত্রে ১৩ লাখ টন বেশি উৎপাদন হয়েছে। ’১৭ সালে সরকারি ও বেসরকারি গুদামে আমদানিটাও বেশি হয়েছিল।’

কিন্তু যারা ধান উৎপাদন করেছেন এবং দাম কমায় বিপাকে পড়েছেন তাদের কী হবে?- এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘এবার তাদের কিছুটা ক্ষতি হবে। তবুও আমরা চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব কেনার।
তিনি বলেন, ‘কিছুদিনের মধ্যে ধান কাটা শেষ হলেই ফসলের পরিমাণ দেখে তারা রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশে এ সিদ্ধান্ত অনেক ভেবেচিন্তে নিতে হবে।
দেশের কৃষকরা যেখানে দাম পাচ্ছেন না সেখানে তারপরও বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গণমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আবদুর রাজ্জাক বলেন, পত্রিকার খবর সঠিক নয়। পত্রিকায় বলা হয়েছে দুই লাখ টনের এলসি আছে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি ৯৭ হাজার টন।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে কৃষি এখন এক ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কৃষির অনেক যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে। সেটি আরও বেশি হলে দাম নিয়ে এই সমস্যা থাকবে না। কৃষকদের এসব যন্ত্র কিনতে সাবসিডি (ভর্তুকি) দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ধান রপ্তানি করে কীভাবে দাম স্থিতিশীল করা যাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রচ-ভাবে দুর্যোগপ্রবণ। আমাদের ভয় হলো হঠাৎ যদি বন্যা হয় তাহলে আবার আমরা বিপদে পড়ব। এ জন্য চিন্তাভাবনা করে রপ্তানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ সূত্র : বিবিসি বাংলা

অজুহাত নয় সরাসরি কৃষকের থেকে ধান কিনুন : হাসানুল হক ইনু
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, সরকারকে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে হবে। সরকারি গুদাম খালি না থাকলে বেসরকারি ও ব্যক্তিগত গুদাম ভাড়া নিয়ে ধান মজুদ করুন। আপাতত চাল আমদানি বন্ধ রেখে চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদিত চাল রফতানির ব্যবস্থা করার কথা ভাবতে হবে।

রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে তিনি এসব কথা বলেন। সরকার নির্ধারিত ১০৪০ টাকা মণ দরে ধান কেনার দাবিতে এ মানববন্ধনের আয়োজন করে জাতীয় কৃষক জোট।

ইনু বলেন, ‘কোনো অজুহাত শুনতে চাই না, কৃষক বাঁচাতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় করতে হবে। প্রয়োজনে অর্ধেক দাম আগাম দিয়ে কৃষকের গোলায় ধান রাখা ও সরকারি গুদামে সরবরাহের পর বাকি অর্ধেক দাম পরিশোধ করার পদ্ধতি চালু করে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করতে হবে।’

সাবেক এ তথ্যমন্ত্রী বলেন, সরকারি গুদাম খালি না থাকলে বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতের গুদাম ভাড়া নিতে হবে। আপাতত চাল আমদানি বন্ধ রাখতে হবে। দেশের চাহিদা অতিরিক্ত উৎপাদিত চাল রপ্তানির ব্যবস্থা করার কথা ভাবতে হবে। সার, বীজ, কীটনাশক, ডিজেল, বিদ্যুৎ, শ্যালো মেশিন, পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, ডিপ টিউবওয়েল, ধান মাড়াইযন্ত্রসহ কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতির দাম কমাতে হবে।

সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি গুদামের সম্প্রসারণ ও ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে কৃষিপণ্য বিপণন সমবায় গড়ে তুলতে হবে। কৃষকের নিজের উৎপাদিত শস্য নিজের রাখার জন্য সংরক্ষণে গোলা তৈরির জন্য ‘গোলা’ ঋণ দিতে হবে।

জাসদ সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, ধানের দাম নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগী, দালাল, ফড়িয়া, চাতাল ও চালকল মালিক, চাল আমদানিকারকসহ ধান-চাল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যেন কোনো কারসাজি করতে না পারে সেজন্য সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।

তিনি ইউনিয়ন ভিত্তিক ধান চাষ ও ধান চাষিদের তথ্যসমৃদ্ধ ডাটাবেজ তৈরির দাবি জানান।

এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন- জাতীয় কৃষক জোটের সাংগঠনিক সম্পাদক রতন সরকার, জাসদ কার্যকরী সভাপতি রবিউল আলম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাভোকেট হাবিবুর রহমান শওকত প্রমুখ।

বিশেষজ্ঞ মন্তব্য

উৎপাদকের ৭৫% মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
সভাপতি, সিপিবি


খুদে উৎপাদকরাই দেশের সিংহভাগ ধান উৎপাদন করে থাকে। সে ধানকে চালে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া কিছুটা ব্যয়বহুল বলে তারা শরণাপন্ন হতে বাধ্য হন বিত্তবান ও মুনাফাশিকারি
ব্যক্তিমালিকানাধীন রাইস মিলে। সেখানেই তাদের কষ্টে ফলানো ধান বেচতে হয় পানির দামে। উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে এ চাল আসতে বড় একটি সিন্ডিকেট পার হতে হয়। তারাই নানা পর্যায়ে চালের দাম বাড়ায় কিন্তু কৃষকের ধানের দাম থেকে বঞ্চিত করে।

কৃষকদের এ বঞ্চনা থেকে রক্ষা করা যেত যদি সরকার খোদ উৎপাদনকারী-কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার ব্যবস্থা করত। সে জন্য উৎপাদন খরচের ১০ শতাংশ বেশি দাম নির্ধারণ করতে হবে সরকারকে। ওয়ার্ডে না হলেও অন্তত ইউনিয়ন পর্যায়ে ‘সরকারি ধান ক্রয় কেন্দ্র’ স্থাপন করে, কোনোরকম কারসাজি বা ‘কমিশন’ খাওয়া বা চাঁদাবাজি ব্যতিরেকে, মৌসুমের গোড়া থেকেই ধান কেনা শুরু করতে হবে। সরকার যদি আন্তরিক হয় তার আগেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃষকের কল্যাণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। সরকারের উদ্যোগে ‘ক্রয় কেন্দ্র’ স্থাপন করে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিংবা তাদের সমবায়ের কাছ থেকে লাভজনক দামে শস্যসহ কৃষিপণ্য ক্রয় করার পাশাপাশি সরকারিভাবে ‘ধান’ ক্রয়ের পরিমাণ কয়েকগুণ বাড়াতে হবে। ‘আর্দ্রতা’ বা ‘মান’ ইত্যাদি অজুহাতে প্রতারণা বন্ধ করতে হবে। চূড়ান্ত ভোক্তা যে দামে কৃষিপণ্য কিনে, খোদ উৎপাদককে তার ৭৫ শতাংশ মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। রাইস মিলগুলোর মালিকানায় মেহনতি কৃষকের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা এবং কৃষক সমবায়ের উদ্যোগে রাইস মিল প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ ও সহায়তা দিতে হবে। সরকারের উদ্যোগে পর্যাপ্তসংখ্যক আধুনিক রাইস মিল স্থাপন করতে হবে। খোদ মেহনতি কৃষকদের নিয়ে ‘উৎপাদক সমবায়’ এবং ভোক্তাদের নিয়ে ‘ভোক্তা সমবায়’ গড়ে তুলে দুই প্রান্তের এই দুই সমবায়ের মধ্যে সরাসরি কৃষিপণ্য বেচাকেনার ব্যবস্থা করতে হবে। উৎপাদক-কৃষকদের নাম রেজিস্ট্রেশন করে তাদের কৃষক-আইডি কার্ড দিতে হবে। রাষ্ট্রের উদ্যোগে, প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে তাদের স্বল্পমূল্যে কৃষি উপকরণগুলো সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং গ্রামের গরিব মানুষের সাংসারিক ব্যয়সীমার মধ্যে রাখার জন্য রেশনিংসহ গণবণ্টন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

কৃষকদের প্রতি রাষ্ট্র অবহেলা করছে

সৈয়দ আবুল মকসুদ
লেখক-বুদ্ধিজীবী


কৃষকদের পক্ষ থেকে যেসব দাবি তোলা হচ্ছে, প্রতীকী আন্দোলন করা হচ্ছে- এসব দাবি অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত। আমাদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে কৃষকদের দাবি-দাওয়া পূরণ ছাড়া একটি টেকসই অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমি মনে করি, কৃষকদের প্রতি রাষ্ট্রের একধরনের অবহেলা প্রদর্শন করা হচ্ছে। কৃষিতে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে কিন্তু এই ভর্তুকি অন্য সেক্টরের ভর্তুকির সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। কৃষকদের ভর্তুকি রাষ্ট্রের এবং জনগণের কল্যাণেই। জনগণের অর্থই ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, জনগণের স্বার্থে। সুতরাং, এখন কৃষকরা যেসব দাবি-দাওয়া করছেন এগুলোর মীমাংসা করা এবং মেনে নেওয়া রাষ্ট্রের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে সরকারের অবশ্য করণীয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেদিকে কর্তৃপক্ষের খেয়াল নেই।

চাল রপ্তানির সুযোগ করে দেওয়া উচিত

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
গবেষণা পরিচালক, সিপিডি


উৎপাদিত ধানের কম দাম পাওয়া এটা কৃষকদের জন্য অবশ্যই দুঃখজনক। বেশি খরচে উৎপাদন করে সেটা কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তাদের যৌক্তিক দাম পাওয়ার সুযোগ করে
দেওয়া উচিত। সেদিক থেকে ইমিডিয়েটলি আমার মনে হয়, কিছু বিষয় সরকার হিসাব করে দেখতে পারে। প্রাক্কলনটা দরকার আছে, এখনই। সেটা হলো, আগামী মাসগুলোতে দেশে চালের কী পরিমাণ চাহিদা রয়েছে; যদি আপদকালীন বা দুর্যোগকালীন কিছু চাহিদা তৈরি হয় সেটা কেমন, কী পরিমাণ স্টক রয়েছে এবং উৎপাদন কেমন হতে যাচ্ছে এসব প্রাক্কলনসাপেক্ষে কৃষি ব্যবস্থাপনা সাজানো দরকার। কৃষক নতুন চাল বাজারে বিক্রির চেষ্টা করছে। এ মুহূর্তে যতটা দ্রুত সম্ভব নির্দিষ্ট পরিমাণ একটা অংশ যদি সরকার রপ্তানির সুযোগ করে দেয় তাহলে কৃষকরা বাঁচবে। বাজারে হয়তো এখন মূল্যের ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রয়েছে সেটা কিছুটা সক্রিয় হবে। তবে এ সিদ্ধান্ত যদি আরও সময়ক্ষেপণ হয় তাহলে কৃষক পর্যায় থেকে চালগুলো মিল পর্যায়ে চলে যাবে। তখন কৃষকও যে কোনো দীর্ঘসূত্রতার সিদ্ধান্তের কারণে বঞ্চিত হবে।

এর আগেও আমরা দেখেছি, আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ার কারণে ভোক্তা পর্যায়ে একটা বড় প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। যে কোনো বিষয়ে একটা ত্বরিত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। সেটা করার ক্ষেত্রে খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় আমাদের চালের যদি উদ্বৃত্ত থাকার সম্ভাবনা থাকে সেটা নিয়ে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল রপ্তানির সুযোগ করে দিলে বাজারে কৃষক পর্যায়ে মূল্যের ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করি।

এনে রাখতে হবে দেরি করলে কৃষকরা এ সুবিধাটা না পেয়ে হয়তো মিল মালিকরাই সুবিধাটা বেশি পাবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে যেটা, সেটা হলো চালের উৎপাদন ব্যয় কীভাবে কমিয়ে আনা যায়। কেননা কৃষকের এবার বড় সমস্যা হয়ে গেছে, উৎপাদন ব্যয় অত্যধিক বেড়ে যাওয়া। সুতরাং চালের উৎপাদন ব্যয় কমানোর ক্ষেত্রে এখন যেমন শ্রমিকের ব্যয় অনেক বেশি; কামলা ব্যয় অনেক বেশি পড়ে যাচ্ছে। এটাকে কমানোর ক্ষেত্রে যেহেতু শ্রমিকের সরবরাহ কমে যাচ্ছে; গ্রামে জমিতে কাজ করার শ্রমিক কম পাওয়া যাচ্ছে। দ্রুত মেকানাইজেশনের বিষয়ে- বিশেষ করে হার্ভেস্টিং, প্ল্যান্টিং বা অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজকে কীভাবে আরও দ্রুত মেকানাইজ করা যায় এবং তার মাধ্যমে উৎপাদন ব্যয় কীভাবে কমিয়ে আনা যায় সে রকম একটি কৌশল নেওয়া দরকার। ভর্তুকি মূল্যে যাতে এসব মেশিনারি আসতে পারে, কৃষক সমিতি যাতে মেশিনারিগুলো কিনতে পারে এসব বিষয়গুলো দীর্ঘ মেয়াদে সরকারের চিন্তা করা উচিত।

 
Electronic Paper