ঢাকা, সোমবার, ৮ জুলাই ২০২৪ | ২৩ আষাঢ় ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
🕐 ৮:২৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ০৩, ২০২৪

সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ

বঙ্গোপসাগরে বিস্তৃত একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চলে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের জন্য সুনীল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপদান সামুদ্রিক মৎস্য; যা প্রাণী-ভিত্তিক প্রোটিনের ৫২ শতাংশ অবদান রাখে। সমুদ্রে অফুরন্ত সম্ভাবনার প্রধান উৎস মাছের বাইরেও রয়েছে জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলজি, জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজভাঙা শিল্প, সামুদ্রিক জলজ প্রাণীর চাষাবাদ, লবণ উৎপাদন, সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, তেল-গ্যাস ও অন্যান্য সামুদ্রিক খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান, সামুদ্রিক বাণিজ্য, জাহাজীকরণ এবং পরিবহন, সমুদ্রবন্দর ও সমুদ্র পর্যটন। এই ক্ষেত্র বা উপাদানগুলোকে যথোপযুক্ত আহরণ ও ব্যবহার করতে পারলে সামুদ্রিক সম্পদ বড় সম্পদে পরিণত হবে। তবে সমুদ্র অর্থনীতির সুফল টানতে বাংলাদেশকে পার্টনারশিপ বা অংশীদারিত্বের পথে হাঁটতে হবে। সে ক্ষেত্রে শুধু বিনিয়োগ নয়, কারিগরি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় নিয়েও ভাবতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গতকাল বুধবার ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘বিশ্ব মহাসাগর দিবস’ উপলক্ষে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদের সঠিক ধারণা ও ব্যবহার নিশ্চিতে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

জাতিসংঘের হিসাবে, সুনীল অর্থনীতি থেকে বিশ্বব্যাপী মৎস্য, জলজ কৃষি, পর্যটন, জ্বালানি পরিবহন, সামুদ্রিক অবকাঠামো এবং শিল্পের মতো বিভিন্ন খাত থেকে বার্ষিক ৩ থেকে ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার উৎপন্ন করে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অর্থনীতেও সুনীল অর্থনীতির অবদান জিডিপির ৪ শতাংশ। সেখানে বিশাল সমুদ্রসীমা থাকা সত্বেও সমুদ্র অর্থনীতি থেকে বাংলাদেশ ৬.২ বিলিয়ন বা জিডিপির মাত্র ৩ শতাংশ অবদান রাখছে।

আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন ওশান প্রসপারিটি : ক্যাটালাইজিং ব্লু ইকোনমি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্লু ইকোনমির গুরুত্ব অনেক। ব্লু ইকোনমি সামুদ্রিক সম্পদের ব্যবহার বৃদ্ধিতে অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র উন্মোচন করেছে। সুতরাং সামুদ্রিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের পাশাপাশি অতিরিক্ত মাছ ধরা নিয়ন্ত্রণ, সমুদ্র দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার মতো চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে। ব্লু ইকোনমি খাতের সাফল্য পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্বের ওপর নির্ভর করে। সরকার, উন্নয়ন সহযোগী, বেসরকারি খাত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিলে একত্রে কাজ করলে সামুদ্রিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব।

পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম বলেন, বেসরকারি খাত ও গবেষকদের সমন্বয়ে সরকারের দেশের সমুদ্র সম্পদকে টেকসইভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গেলে ব্লু-ইকনোমি কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। সমুদ্র নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। বাংলাদেশ বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। সমুদ্রকে কাজে লাগিয়ে আমরা অভ্যন্তরীণ ও আন্তজার্তিক পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে কাজ করছি।

‘পলুশান অ্যান্ড ওসান হেল্থ’ শীর্ষক সেশনে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, দূষণ মোকাবিলার মাধ্যমে সমুদ্রের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর, উদ্ভাবনীমূলক ও টেকসই সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থা, বেসরকারি খাত এবং সুশীল সমাজের সম্মিলিত সহযোগিতায় সম্ভাব্য সমাধানসমূহ খুঁজে বের করা ও তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে।

মন্ত্রী বলেন, ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি স্থান মহাসাগর বা সমুদ্রের অন্তর্ভুক্ত। প্লাস্টিক দূষণ, রাসায়নিক দূষণ, ভারী ধাতুজনিত দূষণ, তেল ছড়িয়ে পড়া এবং সামুদ্রিক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন ধরনের দূষণের কারণে সমুদ্রের সামগ্রিক স্বাস্থ্য বা পরিবেশ মারাত্মক সংকটের মধ্যে রয়েছে। দূষণ সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের অবনতি করছে, উদ্ভিদ ও প্রাণীর ক্ষতি করছে এবং মানব স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। এ সমস্যার সমাধানে আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং জরুরি ও সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। তাছাড়া সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে সামুদ্রিক দূষণ নিয়ন্ত্রণকে সর্বাগ্রে গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।

‘সাসটেইনেবল ব্লু প্রোডাকশন’ বিষয়ে ব্রেক আউট সেশনে সভাপতি বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই উৎপাদন ও আহরণের উপায় খুঁজে বের করে সমুদ্রের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধন করা। সুনীল অর্থনীতির অপার সম্ভাবনার যে বিশাল সমুদ্রসীমা আমাদের রয়েছে সেটিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব তো বটেই, আমাদের নিজস্ব অর্থনীতির ভিতও মজবুত করা সম্ভব হবে।

‘সমুদ্র সমৃদ্ধি-বাংলাদেশে নীল অর্থনীতির অনুঘটক’ বিষয়ে ব্রেক আউট সেশনে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ ও এর যথাযথ ব্যবহারের গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার চলতি অর্থ বছরে গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য টাকা বরাদ্দ করেছে। সামুদ্রিক সম্পদের গবেষণা ও কাজে লাগানোর জন্য এ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য বিপুল সামুদ্রিক সম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। সুনীল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য উদ্ভাবনী অর্থায়ন মডেল অপরিহার্য। আমাদের ব্লু-ইকোনমি সেল সামুদ্রিক খনিজ এবং অন্যান্য সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য ২০টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় করে কাজ করছে।

‘বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড মেরিন রিসোর্সেস’ শিরোনামে ব্রেকআউট সেশনে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সুনীল অর্থনীতিতে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। আমরা সুনীল অর্থনীতি নিয়ে কাজ করব। আর সুনীল অর্থনীতিকে দেশের মূল অর্থনীতিতে কাজে লাগাতে গবেষণায় সাপোর্ট দিতে হবে। কারণ গবেষকদের জন্য দেশ এগিয়ে যেতে পারছে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, মেরিন ট্রান্সপোটেশন আমাদানি রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে যেসব চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ভবিসৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই সমুদ্র নিশ্চিত করতে হবে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসাইন বলেন, ডেল্টা পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার পাশাপাশি সমুদ্রকে কাজে লাগাতে বন্দরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে চলেছে সরকার। এ ছাড়া মৎস্য আহরণ, খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পর্যটনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চল। এখানে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এটিকে কাজে লাগাতে কাজ চলছে।

এডিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, বাংলাদেশের টেকসই অর্থনীতির জন্য সুনীল অর্থনীতির বিকল্প নেই। এডিবি এ খাতে সহায়তা দেবে।

প্রসঙ্গত, সুনীল অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে ২০১২ এবং ২০১৪ সালে প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের বুকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশি জায়গায় বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠার ফলে সম্ভাবনার এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত এবং ব-দ্বীপ সংক্রান্ত অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলা করে দীর্ঘমেয়াদে পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ সরকার ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ শীর্ষক শতবর্ষব্যাপী একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে।

 
Electronic Paper