বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
ছুটি ছাড়াই ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত উপাচার্য
সিলেট ব্যুরো
🕐 ৯:০১ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৪
গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকেই ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত সিলেটের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডাঃ এনায়েত হোসেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপাচার্য, ট্রেজারার ও রেজিস্ট্রারকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগের সময়সীমা বেঁধে দেওয়াসহ ৩ দফা দাবি জানালেও এখন পর্যন্ত কেউ পদত্যাগ করেননি।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ডাঃ এনায়েত হোসেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চোখের চিকিৎসক ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে হাসিনার পদত্যাগ পরপরই গা ঢাকা দেন এনায়েত হোসেন। গত ৫ আগস্টের পর থেকে কোনোও ধরণের ছুটি ছাড়াই টানা ৫০ দিন ধরে ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত উপাচার্য। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এভাবে চলতে থাকলে অধিভুক্ত ১৮টি প্রতিষ্ঠানে সেশনজটসহ নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, গত রোববার সকালে উপাচার্য প্রফেসর ডাঃ এনায়েত হোসেন ঢাকা থেকে ফ্লাইটে সিলেটে আসেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে তিনি ক্যাম্পাসে আসেন নি। সূত্রের খবর ওইদিন বিকেলে তিনি আবারও ঢাকায় ফিরে গেছেন। সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে উপাচার্যের সিলেটে আসার তথ্যটি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
খোলা কাগজের সাথে আলাপকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, উপাচার্য ৫ আগস্টের পর থেকে ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত। তিনি ক্যাম্পাসে আসছেন না আবার পদত্যাগও করছেন না। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দফতরে জানানো হয়েছে। এ সময় তারা উপাচার্য, ট্রেজারার ও রেজিস্ট্রার এর পদত্যাগের জোর দাবি জানান।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ট্রেজারার ও রেজিস্ট্রারের পদত্যাগ দাবিতে গত ৭ আগস্ট থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারী। হাসিনার পতনের পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন ভিসি, ট্রেজারার ও রেজিস্ট্রার। তারা কেউই অফিসে আসছেন না। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বন্ধ রয়েছে অফিসের কার্যক্রম। আন্দোলনকারীরা বলছেন তাদের এক দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
ভিসির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযোগ করেছেন, ভিসি হিসেবে এনায়েত হোসেনের সিলেটে সার্বক্ষণিক অবস্থান করার বিধান থাকলেও তিনি সপ্তাহে গড়ে চার দিন ঢাকায় থাকেন। সচরাচর তিনি মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকেন। বাকি সময় চক্ষুবিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক ঢাকায় চেম্বারে রোগী দেখেন। এর বাইরে তিনি যখন সিলেটে অবস্থান করেন, তখন এখানেও চেম্বারে রোগী দেখে থাকেন। আর এটার প্রমাণ মিলেছে দুজনের কাছ থেকে। তাদেরই একজন নগরীর জিন্দাবাজার রাজা ম্যানশনের ব্যবসায়ী সুহেল আহমদ। দীর্ঘদিন থেকে তিনি চক্ষু সমস্যায় ভুগছেন। তিনি জানান, অনেক ডাক্তার দেখিয়ে তার চক্ষু ভালো না হওয়ায় সর্বশেষ তিনি এনায়েত হোসেনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
সুহেল জানান, নগরের পূর্ব জিন্দাবাজার এলাকার কম্পিউটার অপটিক এবং সিলেটের দক্ষিণ সুরমার পাঠানপাড়া এলাকায় ইনক্লুসিভ আই হসপিটালে-এই দুই জায়গাতেই বিভিন্ন সময়ে তিনি এনায়েতের চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। ভিসির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে এভাবে চেম্বার করার বিষয়টি অনৈতিক হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
নার্সিং কলেজে দুর্নীতি
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজগুলোর পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্র পরিদর্শনের নিয়ম আছে। এর বিপরীতে প্রতিবার ভিসির জন্য ৫ হাজার টাকা এবং বাকি সদস্যদের জনপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র পরিদর্শনে না গিয়েই অর্ধলক্ষাধিক টাকার বিল তুলে নেয়ার অভিযোগ এনায়েত হোসেনের বিরুদ্ধে।
গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ১৩ বার কেন্দ্র পরিদর্শন দেখিয়ে এনায়েত হোসেন ৬৫ হাজার টাকা বিল প্রস্তুত করে আয়কর বাদ দিয়ে ৫৮ হাজার ৫০০ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগার থেকে তুলে নেন। কেন্দ্র পরিদর্শন না করেই এমন বিল তুলে নিয়ে তিনি বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন। শুধু তাই নয়, তার আশীর্বাদপুষ্ট হিসেবে পরিচিত সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালনকারী মো. বিলাল আহমদ চৌধুরীও ভিসির মতো ১৩ বার কেন্দ্র পরিদর্শন দেখিয়ে টাকা তুলে নেন। অন্য তিন সদস্য সর্বনিম্ন ২টি থেকে সর্বোচ্চ ৪টি কেন্দ্র পরিদর্শন দেখিয়ে বিল তুলেছেন।
পরিদর্শন কমিটির একজন সদস্য সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ শিশির রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, তিনি যখন তিনটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেন, তখন ভিসি এনায়েত হোসেন সঙ্গে ছিলেন না।
দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়ম
জাতীয় একটি দৈনিকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দাপ্তরিক ভবনের মেরামতকাজের (সিভিল, স্যানিটেশন, বৈদ্যুতিক কাজ) জন্য আগ্রহী ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোটেশন আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ওই কোটেশন আহ্বান করেন মেরামতকাজ সম্পাদন ও তদারকি কমিটির সভাপতি ভিসি এনায়েত হোসেন। কোটেশন জমাদানের শেষ তারিখ ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি। সর্বনিম্ন দরদাতা দেখিয়ে এ কাজটি দেয়া হয় সিলেট নগরের বালুচর এলাকার মেসার্স আফরা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি পণ্য সরবরাহ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।
একই সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আফরা এন্টারপ্রাইজ ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩০০ টাকা দর দেখিয়ে কাজ পেয়েছিল। ভ্যাট ও আয়কর বাদে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৫ লাখ ২৩ হাজার ৫১২ টাকার চেক পায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষকে এড়িয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে দেয়া চেক পাস হয় ভিসির স্বাক্ষরে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী চেকে কোষাধ্যক্ষের স্বাক্ষর থাকার বিধান রয়েছে।
জানা যায়, কোটেশন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবুল কালাম মো. ফজলুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তবে এ কমিটির সভা কবে হয়েছে, সে তারিখ উপস্থিতি-কাগজে উল্লেখ ছিল না। এছাড়া তিন সদস্যবিশিষ্ট ওই উন্মুক্তকরণ কমিটির সভায় চেয়ারম্যান ছাড়া বাকি দুজনই অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে সেই উপস্থিতি-কাগজে কমিটির চেয়ারম্যান ছাড়া সদস্য সচিব ও সদস্যের কোনো স্বাক্ষরও নেই।
২ লাখ ৯৯ হাজার ২৫০ টাকার সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে উদয়ন অফসেট প্রেস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ১৯ হাজার কপি ‘পরীক্ষার মূল উত্তরপত্র’ সরবরাহ করার জন্য চলতি বছরের ৩ জুলাই কার্যাদেশ দেয়া হয়। এ-সংক্রান্ত কাগজপত্রে দেখা গেছে, ৩ জুলাই দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়। তবে সাত সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটির সভায় কেবল ভিসি ও রেজিস্ট্রার উপস্থিত ছিলেন। বাকি সদস্যদের মধ্যে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. বদরুল ইসলাম, এমসি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. তৌফিক এজদানী চৌধুরী, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক প্রেমানন্দ দাস, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী জয়নাল আহমদ চৌধুরী এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আরিফ আহমদ অনুপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে গতকাল মঙ্গলবার ও আজ বুধবার তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি।
প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক এই মহাপরিচালক গত বছরের ১ জানুয়ারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি তোলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে কোনো ধরনের ছুটি ছাড়া গত ৫ আগস্ট থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত। শুধু তাই নয় আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তাঁর ভয়ে তটস্থ ছিলেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তিনি তাঁর পছন্দের কয়েজন কর্মকর্তাকে দিয়ে আলাদা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন। এই সিন্ডিকেট দিয়েই নানা অপকর্ম করাতেন তিনি।