ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে দুর্নীতির বরপুত্র আলাউদ্দিন নাসিম

জোবায়ের হোসেন, ফেনী
🕐 ৩:২০ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪

এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে দুর্নীতির বরপুত্র আলাউদ্দিন নাসিম

শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন নাসিম দেশটিকে বানিয়েছিলেন অনিয়ম ও দুর্নীতির ‘স্বর্গরাজ্য’। মিস্টার টোয়েন্টি পার্সেন্ট হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন দেশব্যাপী। তাকে ২০ পার্সেন্ট কমিশন না দিলে কোনো টেন্ডারই পেতো না ব্যবসায়ীরা। প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই তিনি বুঝে নিতেন তার কমিশনের টাকা। বিভিন্ন সময় দুর্নীতির কারণে অনেকেই ধরা পড়লেও সব সময় অন্তরালে থেকে যেতেন দুর্নীতির বরপুত্র খ্যাত আলাউদ্দিন নাসিম। শেখ হাসিনার ম্যানেজার হিসেবে ছিলেন বহাল তবিয়তে।

বিদ্যুৎ সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবেও আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন ফেনী-১ এর সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। যার হাত ধরে দেশে গত সাড়ে ১৫ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতে মহালুটপাটের ঘটনা ঘটেছে সেই আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শেখ হাসিনার ঘনিষ্টজন হওয়ায় বিনা পুঁজিতে ব্যবসায়িক পার্টনার হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের প্রকল্প থেকে বিদেশে পাচার করেছেন কয়েক হাজার কোটি টাকা।

২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ডাচ-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। শুধু বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা লোন নিয়ে বিদেশে পাচার করেন তিনি। শুধু বিদ্যুৎ প্রকল্পই নয়,জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে আরও ঋণ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে নাসিমের বিরুদ্ধে।

বিগত সরকারের আমলে প্রভাবশালী এই সাবেক এমপিকে ব্যবসায়িক পার্টনার বানিয়ে কোনো রকম টেন্ডার বা প্রতিযোগিতা ছাড়াই সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় বড় প্রকল্প বাগিয়ে নেন এক আলোচিত ব্যবসায়ী। তাকে সামনে রেখেই চালানো হয় লুটপাট। এসব কারণেই ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সম্প্রতি দুদকে জমা পড়া একটি অভিযোগ থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই নাসিম হয়ে উঠেন অঘোষিত গডফাদার। চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে রাঘববোয়াল হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। গত ১৭ বছরে তিনি অবৈধ উপায়ে গড়েছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড়। তিনি সাবেক আমলা ও ১৩ বছর ছিলেন শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নাসিম চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রতীকে নির্বাচিত হন। তার বিরুদ্ধে এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, বিএনপি নেতাকর্মী এবং জামায়াতের নেতাকর্মীদের জুলুম-নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে দখল বাণিজ্য, চাঁদাবাজি এবং সরকারি টেন্ডার বাণিজ্য করে অবৈধ উপায়ে শত কোটি টাকা উপার্জনের অভিযোগ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একটি সূত্র জানায়, সাবেক এমপি নাসিমের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থ-সম্পদের অভিযোগ করেছেন ফেনীর পশুরামের বাসিন্দা মঈন আহমেদ নামে এক ব্যক্তি। অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক অর্থ-সম্পদের খোঁজে কাজ করছে।

গত ৯ আগস্ট দুদকে জমা দেওয়া ওই অভিযোগ থেকে জানা যায়, হাসিনা সরকারের নৌকা প্রতীকের টিকেট নিয়ে ফেনী-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আলাউদ্দিন নাসিম। ছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য। ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি হিসেবে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগ আওয়ামী লীগের অভিভাবক। তার সক্রিয় ভূমিকায় চলত বৃহত্তর নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের প্রশাসন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর অন্য মন্ত্রী-এমপিদের মতো আলাউদ্দিন নাসিমও আত্মগোপনে চলে যান। স্থানীয়দের অভিযোগ এখন আত্মগোপনে থেকেও বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।

অভিযোগে বলা হয়, ১৯৮৬ সালে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেন আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা হওয়ার পর বাধ্য হয়ে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রভাব বিস্তার করে সেই মামলা থেকে তিনি খালাস পান। ২৩ বছরের চাকরিজীবনে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদ।

অভিযোগে আরও বলা হয়, একসময়ের প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন নাসিম কানাডার নাগরিক হওয়ার পরও হাসিনা তাকে এমপি নির্বাচিত করেন। কানাডা, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে তার ব্যবসা ও বাড়ি-গাড়ি। তার মাধ্যমে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে টাকা পাচার করতেন। নামে প্রটোকল অফিসার হলেও আলাউদ্দিন নাসিমের কাজ ছিল বিদেশে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সম্পদ রক্ষা করা।

রাজধানীর অভিজাত গুলশান এলাকায় রয়েছে আলাউদ্দিন নাসিমের মদের গুদাম। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মদের গুদাম বলে আলোচিত। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্লাব থেকে সদস্যদের জন্য কম দামে কেনা মদ তিনি বেশি দামে বিক্রি করেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে হলফনামায় আলাউদ্দিন নাসিম ও তার স্ত্রী ডা. জাহানারা আরজু ১০৮ কোটি ৩৭ লাখ ৪১ হাজার ৮৪৫ টাকার সম্পদ দেখিয়েছিলেন। বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৩ কোটি ৫৭ হাজার ২৯৫ টাকা এবং তার স্ত্রীর ৬৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৫০ টাকা।

স্থানীয়দের মতে, এমপি ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশ-বিদেশে নামে-বেনামে রয়েছে হাজার কোটি টাকার অর্থ-সম্পদ। এ ছাড়াও কানাডায় রয়েছে বাড়ি-গাড়ি। মেয়ে রাকা চৌধুরী এখনও কানাডায় অবস্থান করছেন। এমপি হওয়ার আগেও তিনি পরিবার নিয়ে প্রায়ই কানাডায় থাকতেন। তিনি কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন।

ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের স্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু নির্বাচনের হলফনামায় ১০৮ কোটি ৩৭ লাখ ৪১ হাজার ৮৪৫ টাকার সম্পদের মালিক হিসেবে স্বীকার করলেও বাস্তবে তারা হাজার কোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে তাদের রয়েছে শত শত বিঘা জমি। ঢাকায় রয়েছে অসংখ্য ফ্ল্যাট ও বিলাসবহুল গাড়ি। একজন সরকারি কর্মকর্তা থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ায় হতবাক খোদ এলাকাবাসী।

অভিযোগে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সচিবালয়ের বিভিন্ন দফতরে কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ২০ শতাংশ কমিশন নিতেন নাসিম। এ ছাড়াও বেসরকারি ফেনী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আশপাশের মানুষের কৃষিজমি লিখে দিতে না চাইলে সেই জমি তিনি দখল করে নিয়েছেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০ বিঘার ওপরে গড়ে তোলা ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুকুর রয়েছে ৪টি।

ফেনীর পরশুরামে ৩০ একর জায়গায় ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত করা হয় আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম কলেজ। স্থানীয়দের অভিযোগ, জোরপূর্বক ও ভয় দেখিয়ে নামমাত্র মূল্য পরিশোধ করে কলেজের জন্য কৃষিজমির জায়গা দখল করে নেওয়া হয়। এবার ফেনী-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়ে মনোনয়ন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কায়দাকৌশল করে ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরামে তার অনুসারীদের উপজেলা চেয়ারম্যান বানান। এ ছাড়া নির্বাচনি এলাকার বাইরেও অন্যান্য উপজেলায়ও তার অনুসারীদের চেয়ারম্যান বানান।

অন্যদিকে নাসিমের বাবা সালেহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী একাত্তরে চিহ্নিত রাজাকার ছিলেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাকে রাজাকার থেকে মুক্তিযোদ্ধা বানান। ২০১৩ সালে সালেহ উদ্দিনের তার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ঢোকানো হয়। ২০২০ সালের ২৬ জুলাই মুক্তিযোদ্ধা নামধারী রাজাকার সালেহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী মারা গেলে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়ে দাফন করা হয়।

পজির উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর ছেলে সালেহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি ফেনীর পশুরাম উপজেলা উত্তর গুথুমা গ্রামে। ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট ফেনী মহকুমা পিস কমিটির চেয়ারম্যানের প্রকাশ করা ৯ সদস্যবিশিষ্ট পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগীদের তালিকায় ৭ নম্বর নামটি ছিল সালেহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর। কালের বিবর্তনে ৪২ বছরের ব্যবধানে এই রাজাকার ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল সরকারের গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হয়ে যান। যার গেজেট নং- ২৩৬১।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, সালেহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দিতে ২০১৯ সালের ২০ জুলাই জাতীয় সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা ফাউন্ডেশনের মহাসচিব জি কে বাবুল তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন। বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। যা এখনও আলোর মুখ দেখেনি। অভিযোগ রয়েছে, তদন্তের ওই নির্দেশ ধামাচাপা দেওয়া হয় নাসিমের কারসাজিতে।

রাজধানীর শাহবাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের স্ত্রী ডা. জাহানারা আরজু। তিনি ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে গালি দেন। এ সময় তার নির্দেশে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালায়।

এছাড়াও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের নির্দেশেই জুলাই ও আগস্ট মাসে ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে চলে ছাত্র হত্যা। ফেনীর মহিপালে আওয়ামী লীগের নির্বিচার গুলিতে ৯ জন ছাত্র হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত মোট ৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি করা হয় ২ হাজার ৯৪১ জনকে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে মাস্টারমাইন্ড আলাউদ্দিন নাসিম। ফেনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসনের এমপি ও গুলি করার নির্দেশদাতা আলাউদ্দিন নাসিমকে কেন মামলার আসামি করা হয়নি এ নিয়ে চলছে সর্বত্র জল্পনা-কল্পনা। ফেনীর ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করছেন আলাউদ্দিন নাসিম লিয়াজোঁ করে মামলা থেকে তার নাম বাদ দিয়েছেন। তাই আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অনুসন্ধান করে তাকে আইনের আওতায় আনতে দুদক চেয়ারম্যানের সহযোগিতা কামনা করা হয়।

 

 
Electronic Paper