গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। নিজেদের ঘনিষ্ঠ মিত্রের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। সীমান্তে অস্থিতিশীলতা, বাংলাদেশকে নিয়ে গণমাধ্যমে ও কূটনৈতিক পর্যায়ে প্রোপাগান্ডা ছাড়ানো থেকে শুরু করে দূতাবাসে হামলার মতো কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত ঘটনাও ঘটিয়েছে ভারত। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দৃঢ়তার কারণে প্রতিটি চক্রান্তই ব্যর্থ হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতা বন্ধ করতে ভারত সরকারের প্রতি বিভিন্ন সময়ে আহ্বান জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লিতে বিজিবি ও বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও এ বিষয়ে ছয় বিষয়ে সমঝোতা হয়েছিল। তবু থেমে নেই ভারত। ফের বাংলাদেশের সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তার করছে বিএসএফ। এ ছাড়া মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিরও চেষ্টা করে তারা। এর মধ্যে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ভারতীয় মিডিয়া বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা রকম মিথ্যা তথ্য তুলে ধরে বদনাম ছড়াচ্ছে। এ বিষয়ে দেশবাসীকে সজাগ থাকারও আহ্বান জানান তিনি।
গতকাল সোমবার সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে ফের শূন্য রেখায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে বিজিবি উপস্থিত হয়ে বাধা দিলে কাজ বন্ধ রাখা হয়। এ নিয়ে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম সীমান্তে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
স্থানীয়রা জানান, দহগ্রাম সর্দারপাড়া সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের (প্রধান ডিএএমপি পিলার ৪২ বাই ৪৮ নম্বর উপপিলারের কাছে গতকাল সকাল থেকে শূন্যরেখায় আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে লোহার খুঁটি স্থাপন করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বিএসএফ ৬ ব্যাটালিয়নের অরুণ ক্যাম্পের সদস্যদের সহায়তায় এ বেড়া নির্মাণ করতে থাকে। স্থানীয়রা বিষয়টি বিজিবিকে জানালে ঘটনাস্থলে বিজিবি গিয়ে বাধা দেয়। একপর্যায়ে কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় বিএসএফ। এ নিয়ে সীমান্তবাসীর মধ্যে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
ওই এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিএসএফ কয়েকদিন পর পর জিরো পয়েন্টে এসে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টা করে। এতে আমরা সীমান্তবাসী আতঙ্কে থাকি। নিজের জমিতে যেতে ভয় পাই। বিজিবি রংপুর ৫১ ব্যাটালিয়নের পানবাড়ি কোম্পানির কমান্ডার সুবেদার লুৎফর রহমান বলেন, আমরা এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে কাজ বন্ধ করতে বলেছি। তারা কাজ বন্ধ করেছে। পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। সীমান্তে বিজিবির টহল ও নজরদারি অব্যাহত আছে। পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুজ্জামান সরকার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ঘটনাস্থলে এক অফিসারকে পাঠানো হয়েছে।
কথা রাখেনি ভারত
গত ১৭ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বিজিবি ও বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে ছয়টি বিষয়ে মতৈক্য হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল সীমান্তে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর গুলি চালানো, হত্যা, আহত বা মারধরের ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। সেইসঙ্গে সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কোনো স্থাপনা, কাঁটাতারের বেড়া, প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত হয়, এমন কোনো স্থাপনা বা বাংকার নির্মাণের ক্ষেত্রে উভয় দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ পরিদর্শক দলের পরিদর্শন এবং যৌথ আলোচনার দলিলের ভিত্তিতে নির্মাণের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে বন্ধ থাকা অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের ব্যাপারে যথোপযুক্ত পর্যায়ে জয়েন্ট ভেরিফিকেশনের (যৌথ যাচাই) মাধ্যমে দ্রুত সমাধান করা হবে। কিন্তু সেই কথা উপেক্ষা করেই সীমান্তে ফের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টা চালায় বিএসএফ।
টার্গেট কিলিংয়ের পথে হাঁটছে র’
এদিকে বাংলাদেশ নিজেদের আধিপত্য পুনপ্রতিষ্ঠায় গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং র’। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে নানা ধরনের সাজানো আন্দোলনের উসকানিসহ গোপন কিলিং মিশনেও নামছে ভারতীয় এ গোয়েন্দা সংস্থাটি। সম্প্রতি ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মাঠে নামার চেষ্টা করে ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের কুশীলবরা। যান নেতৃত্ব দেন স্লোগনকন্যা নামে খ্যাত লাকি আক্তার। অভিযোগ আছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ সম্পূর্ণ র’য়ের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে। তবে গণজাগরণ মঞ্চের পুনরুত্থান ঠেকিয়ে দেয় ছাত্র-জনতা।
এ ছাড়া সুব্রত বাইনসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর হঠাৎ করে সক্রিয় হয়ে ওঠাও নতুন করে শঙ্কা ছড়াচ্ছে। সুব্রত বাইনের সঙ্গে ভারতীয়দের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন বেশ কয়েকজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক। তারা বলছেন, বাংলাদেশে নানাভাবে অপতৎপরতা চালাচ্ছে ভারতীয়রা। সম্প্রতি বিভিন্ন আন্দোলনে তাদের এ দেশীয় এজেন্টরা যুক্ত হয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন। তারা আরো আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশে গোপন কিলিং মিশন পরিচালনা করতে পারে র। তারই পূর্ব নতুনা হচ্ছে সুব্রত বাইনসহ শীর্ষ সন্ত্রসীদের প্রকাশ্য তৎপরতা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার
সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ইকোনমিক টাইমস এবং ইন্ডিয়া টুডে সম্প্রতি সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা এবং চেইন অব কমান্ড ভাঙার মতো ভিত্তিহীন ও মনগড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তবে ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়ে প্রকাশ করা সংবাদ মিথ্যা ও পরিকল্পিত বলে দাবি করেছে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর বা আইএসপিআর। গত মঙ্গলবার রাতে আইএসপিআরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দ্য ইকোনমিক টাইমস ও দ্য ইন্ডিয়া টুডেসহ ভারতের কিছু সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত একের পর এক ভিত্তিহীন ও মনগড়া প্রতিবেদন গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ওইসব প্রতিবেদনে সেনাবাহিনীর ভেতরে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা এবং শৃঙ্খলা (চেইন অব কমান্ড) ভেঙে পড়ার কথা বলা হয়েছে। এসব প্রতিবেদন পুরোপুরি মিথ্যা এবং সেগুলো বাংলাদেশ ও এর সশস্ত্র বাহিনীর সুনাম ও স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন করার জন্য পরিকল্পিত অপপ্রচারের অংশ বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, আমরা স্পষ্টভাবে বলছি যে সেনাপ্রধানের দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে। আমাদের চেইন অব কমান্ড শক্তিশালী রয়েছে এবং জ্যেষ্ঠ জেনারেলরাসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সব সদস্য সংবিধান, চেইন অব কমান্ড ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আনুগত্যে অবিচল রয়েছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে অনৈক্য বা আনুগত্যহীনতার যে কোনো অভিযোগ পুরোপুরি বানোয়াট ও বিদ্বেষপূর্ণ।
কেকে/এআর