দ্রুত সময়ের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়, দলের নাম ব্যবহার করে সারা দেশে চাঁদাবাজী নিয়ন্ত্রণ, পদ-পদবি নিয়ে দলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসন করা, যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখাসহ মোটাদাগে পাঁচটি চ্যালেঞ্জের মুখে বিএনপি।
গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় যাচ্ছেন এটা অনেকটা নিশ্চিত দেশের জনগণ। ফলে বিএনপির ওপর প্রত্যাশার চাপ বাড়তে থাকে। এ নিয়ে বিএনপির হাইকমান্ডও অনেক সর্তকভাবে চলতে থাকে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কথাবার্তা, বক্তব্য-বিবৃতিতে অতীতের তুলনায় অনেক বেশি দ্বায়িত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে তারেক রহমানকে ঘিরে নতুন করে কৌতুল তৈরি হয়। সহনশীল রাজনীতি, সারা দেশে দলীয় পদ বা নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজী কঠোর হস্তে দমন করার নির্দেশনা দেন। যার ধারাবাহিকতায় বিএনপির তিন হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে প্রাথমিক সদস্যসহ দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের পতনের পর দেশে বড় রাজনৈতিক দল বলতে এখন বিএনপিকে দায়িত্ব নিতে হবে। আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছে এটা নিশ্চিত। তবে দলটির সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রেখে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদায় করা।
দলীয় সূত্র জানায়, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর সারা দেশে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে যেখান থেকেই অভিযোগ এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দলীয় শৃঙ্খলার প্রশ্নে বিএনপির হাইকমান্ড ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ অবলম্বন করছেন। শুধু দল থেকে বহিষ্কারই নয়, কারো কারো বিরুদ্ধে আইনি প্রদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে দলীয় নীতি ও শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ৭ নেতাকে গত রোববার রাতে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কৃত নেতারা হলেন ঢাকা মহানগর উত্তরের আওতাধীন ৯৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির (কাফরুল থানা) সভাপতি কবির হোসেন মিল্টন, ১৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আবু হানিফ, সিনিয়র সহ-সভাপতি আরিফ মৃধা, ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি সাইফুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক সদস্য আহসান উল্লাহ চৌধুরী হাসান, ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ুন কবির নিখিল এবং ১৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আলম ভূঁইয়া।
এ ঘোষণার পরপরই বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বহিষ্কৃত ও তাদের অনুসারীরা। রাত ১০টার দিকে তারা রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরে বিক্ষোভ করেন। এ বিক্ষোভ থেকে ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমিনুল হকের পদত্যাগ দাবি করা হয়। এ বহিষ্কারাদেশকে পক্ষপাতিত্ব ও ষড়যন্ত্রমূলক বলেও মনে করেন বহিষ্কৃতরা।
নির্বাচন ইস্যুতে কড়া বার্তা দিচ্ছেন বিএনপি নেতারা : নির্বাচন আগে নাকি সংস্কার আগে এমন টানাপোড়নে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে অনঢ় বিএনপি নেতারা। জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশে সফরের পর চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচনের অনুষ্ঠিত হওয়ার আলোচনা যেন ২০২৬ সালের জুনে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন ইস্যুতে ‘টালবাহানা’ কোনো রকম ছাড় দিতে নারাজ দলটির নেতাকর্মীরা। ফলে প্রতিনিয়তই নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি নেতারাদের কণ্ঠ উচ্চকিত হচ্ছে। সরকারকে দেওয়া হচ্ছে কড়া বার্তা।
গত রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচন দেওয়া উচিত। নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব দিয়ে দেশে স্থিতিশীলতা রক্ষা করা উচিত।’ বিএনপি সংস্কারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা এটুকু বলতে পারি, আমরা সংস্কারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা ৩১ দফা দাবি অনেক আগে দিয়েছি, যখন এই সংস্কারের কথা কেউ বলেনি। সেই সংস্কারগুলোর সঙ্গে আজকের যে প্রস্তাব উঠে আসছে, সেখানে খুব বেশি পার্থক্য দেখছি না।’
দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা এখন অন্তত আন্তরিকভাবে চাচ্ছি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দিকে যাবেন। কারণ, আমরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে যেটা দেখছি, নির্বাচন যত দেরি হবে তত বেশি বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে পরাজিত করার জন্য ফ্যাসিস্ট শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। যারা উগ্র, জঙ্গি তারাও এই সুযোগগুলো নেওয়ার চেষ্টা করছে।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে এই ধরনের গভীর বিশ্বাস জনগণের। কিন্তু যদি গড়িমসি হয় তাহলে তো ভিন্ন মাত্রা নেবে।’
ঢাকা মহানগর বিএনপি উত্তরের আহ্বায়ক আমিনুল হক বলেন, ‘গত ছয় মাসেও জাতির সামনে কোনো সংস্কার দৃশ্যমান নেই। কারণ এখনো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসররা বহাল তবিয়তে বসে আছে। সেই স্বৈরাচারদেরকে রেখে আপনারা কীভাবে সংস্কারের কথা বলেন? আগে স্বৈরাচারের নির্মূল করেন, অপসারণ করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে সংস্কার করেন। এমনিতেই বাংলাদেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে সংস্কারের নামে নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এ সরকারকে বুঝতে বেশি দিন সময় দেবে না। ক্ষমতার মোহে সংস্কারের নামে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করলে বাংলাদেশের জনগণ এটা কখনই মেনে নেবে না।’
যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মারাত্মক চক্রান্ত দেখছি। বিরাজনীতিকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। সুকৌশলে নির্বাচন নিয়ে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। সামনে আন্দোলন ছাড়া কোনো বিকল্প দেখছি না।’
যুগপৎ শরিকদের মধ্যে অনৈক্যের সুর : বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন মাঠের আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া যুগপৎ শরিক দলগুলো এখন স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে। নিজ নিজ দলীয় ব্যানারেও তারা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, আগামী দিন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের সুযোগ পেলে যুগপৎ শরিকগুলোকে নিয়ে একসঙ্গে চলতে চায় বিএনপি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে আস্থা পেলেও কেউ কেউ আস্থা-অনাস্থার দোলাচলে রয়েছে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ১২ দলীয় জোটে ভাঙন তৈরি হয়। তবে পরবর্তিতে আবারো সেই ভাঙন জোড়া লাগে।
জানতে চাইলে ১২ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ‘কতিপয় সাংবাদিকের চক্রান্তের ফলে ১২ দলের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হয়। যা ভাঙনের দিকে যায়। পরবর্তিতে আমরা একসঙ্গে বসে ইফতার করে সেই ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটাই।’
কেকে/এআর