পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী, খুন, গুম, টেন্ডার বাণিজ্য, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতনসহ নানা অপরাধে সম্পৃক্ত দেড় শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এখনো বহাল তবিয়তে। গত ১৬ বছর তারা সরকারের বিভিন্ন অপকর্মে সরাসরি সহযোগিতা করেছেন।
কিন্তু ৫ আগস্টের পর, পরিস্থিতি বদলে গেলে তাদের মধ্যে অনেকেই রাতারাতি বিএনপি ও জামায়াতের অন্ধ সমর্থক সেজে সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে এসপি, অতিরিক্ত ডিআইজি, ডিআইজি ও অতিরিক্ত আইজিপির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করেছেন। অন্যদিকে, যারা মেধা, জ্যেষ্ঠতা এবং প্রয়োজনীয় সব যোগ্যতা থাকার পরও বিগত সময়ে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের অবস্থা এখনো একই রয়ে গেছে। পদোন্নতির সুযোগ তো দূরের কথা, তাদের মধ্যে চরম হতাশা ও চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
পুলিশ বাহিনীতে পেশাদার কর্মকর্তাদের অভিমত, যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, তারাই এখন পুরস্কৃত হচ্ছেন। সরকারের এমন পদক্ষেপে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যার কারণে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যেও এক ধরনের হতাশা রয়েছে। বিদায়ী সরকারের ক্ষমতায় থাকার সময় নির্বাচনসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্ত কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। এতে প্রশাসনে যোগ্যতার পরিবর্তে আনুগত্যই প্রাধান্য পাচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। জুলাই বিপ্লবের পরও এরা বহাল থাকায় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক আরো ঘনীভূত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ সদর দফতর, ডিএমপি ও সিআইডিসহ ঢাকাস্থ বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত জাতীয়তাবাদ ও ইসলামপন্থিদের গত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময় ব্যাপকভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। পুলিশে আওয়ামী সিন্ডিকেটের সহযোগীরা ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ের সুবিধা বাগিয়ে নিয়ে গোপনে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের তথ্য ফাঁস ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে আগামীতে এরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
বিসিএস ২০তম ব্যাচের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী, খুন, গুম, টেন্ডার বাণিজ্য, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতনসহ নানা অপরাধে সম্পৃক্ত দেড় শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এখনো বহাল তবিয়তে। তিনি বলেন, দলের লেজুড়বৃত্তি করা বহুল আলোচিত সেই কর্মকর্তারা এখন নেই। রীতিমতো পুলিশের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার মতো অবস্থা তৈরি করে তারা চলে গেছেন। আমরা মর্যাদাশীল একটি পুলিশের অবস্থান চাই, যেখানে সরকার পরিবর্তনের পরও যেন পুলিশের মেরুদণ্ড ঠিক থাকে। কোনো পুলিশ সদস্যকে পালাতে না হয়।
বিসিএস ১৮তম ব্যাচের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ঘাপটি মেরে থাকা কিছু কর্মকর্তা গাছেরটাও খেয়েছে, এখন তলারটাও কুড়াচ্ছেন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে যিনি জেলার এসপি, তিনি এখন রেঞ্জ ডিআইজি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ার পেছনে মূল কারিগর তারাই। এক সময় পুলিশ সদর দফতরসহ পুলিশের সব ইউনিটের টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ যার হাতে ছিল সে কর্মকর্তা এখন সিআইডিতে প্রভাবশালী। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থেকে এরা পতিত আওয়ামী লীগের ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য পাচার করছে বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।
সম্প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পুলিশ কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান এখন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) খুলনা বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি। বেনজীর আহমেদ যখন আইজিপি ছিলেন তখন পুলিশ বাহিনিতে কেনাকাটা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলির একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো মাসুদুর রহমানের। পুলিশ সদর দফতরের পাশাপাশি সারা দেশের বিভিন্ন ইউনিটের শত শত কোটি টাকার কেনাকাটার আইজিপির পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করতেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশের কোনো ইউনিট প্রধান বা জেলার এসপি তার নির্দেশ অমান্য করলেই আর রক্ষা ছিল না। নানা কায়দায় হয়রানির শিকার হতে হয়েছে ওই কর্মকর্তাদের। এক কথায় সাবেক আইজিপি বেনজীরের টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ছিল মাসুদুর রহমানের হাতে।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর ২০ অক্টোবর তাকে পুলিশ একাডেমি সরদায় বদলি করা হয়। অত্যন্ত চালাক ও লবিংবাজ এ কর্মকর্তা অন্তর্বর্তী সরকারের একটি প্রভাবশালী মহলকে ম্যানেজ করে সম্প্রতি সিআইডি ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন। সর্বশেষ গত ১১ মার্চ তাকে সিআইডির খুলনা বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদায়ন করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মাসুদুর রহমান সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের পক্ষে টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে বলেই তিনি (বেনজীর আহমেদ) যখন ডিএমপির পুলিশ কমিশনার ছিলেন, তখন তাকে ডিসি মিডিয়া হিসেবে বদলি করা হয়। পরে তিনি আইজিপি হলে ২০২০ সালের ১০ মে তাকে পুলিশ সদর দফতরে বদলি করান। একপর্যায়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান। সার্বিক বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মাসুদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিবেদককে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কোন কথা বলব না।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অত্যন্ত চালাক পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (এডিশনাল ডিআইজি পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত) আবু হাসান পতিত আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল-প্রলয় কুমার জোয়ারদার ও সুদীপ গ্রুপের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
বিসিএস : ২৪তম ব্যাচের এ কর্মকর্তা ২০১৪ সাল থেকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত। পলাতক অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয়ের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে তাকে দেওয়া হয় বিপিএম পদক। আওয়ামী সিন্ডিকেটের কর্মকর্তা হওয়ার পরেও অন্তর্বর্তী সরকারের এ সময়ে পুলিশ সদর দফতর রয়েছে। এ ব্যাপারে এআইজি আবু হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি পুলিশে চাকরি করতে এসেছি, কোনো গ্রুপ করতে আসিনি। আমি আমার কাজ করছি। এ ধরনের তথ্য সঠিক নয়।
কেকে/এআর