সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন না হলে প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে পুনর্গঠিত করা না হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হলেও ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা ফিরে আসতে পারে
বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর উদ্যোগে ‘রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলী রীয়াজ এসব মন্তব্য করেন।
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক, সাবেক সচিব আবদুল আউয়াল মজুমদার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ সাহান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের মহিউদ্দিন প্রমুখ। লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।
আয়োজিত অনুষ্ঠানে বদিউল আলম বলেন, শেখ হাসিনা দেশে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ ব্যবস্থায় পৌঁছাতে তার ১৫ বছর লেগেছে। তিনি নির্বাচন ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভেঙে দিয়েছিলেন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে কারণে শেখ হাসিনার পলায়নের পর আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য এক অপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে, যাতে একটি ‘নাগরিক সনদ’ তৈরি করা যায়।
আলী রীয়াজ বলেন, সংস্কার শুধু সরকারের ইচ্ছার বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত বিষয়। তাই সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক সনদ প্রণয়ন করতে হলে নাগরিকদের সোচ্চার হতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নটি উঠার কারণ হলো, বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশে ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও ভঙ্গুর করে ফেলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর বিগত ৫৪ বছরে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, আমরা দেখেছি বিগত ১৫ বছরে বিচার বিভাগকে কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন না হলে প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে পুনর্গঠিত করা না হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হলেও ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা ফিরে আসতে পারে। তাই বাংলাদেশে ভবিষ্যতে স্বৈরতন্ত্রের পুনরুত্থান ঠেকাতে হলে কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে। জবাবদিহি মূলক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, বর্তমান সরকারের তিনটি ম্যান্ডেট। একটি হলো- স্বৈরাচারী ব্যবস্থা যাতে আবার ফিরে আসতে না পারে সেজন্য কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করা। দ্বিতীয়ত-মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা। তৃতীয়ত-একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজন করা। এগুলো একই সঙ্গে হতে পারে, কোনোটি অন্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমদাদুল হক বলেন, বিচার বিভাগ নিয়ে অতীতে বিভিন্ন প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন তার প্রতিবেদনে এসব বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করেছে এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ তুলে ধরেছে। আমি মনে করি সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু এখন সময় এসেছে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের।
দিলারা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের মানুষ সত্যিকার অর্থেই ধর্ম নিরপেক্ষ। এখানে সুফিবাদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হয়েছে। কিন্তু তারপর সংস্কার কমিশনের জরিপে ৮৫ শতাংশ মানুষ ধর্ম নিরপেক্ষতার বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন। এর অন্যতম কারণ হলো জর্জ ডব্লিউ বুশের সময়ে শুরু হওয়া ওয়ার অন টেররবা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিচিত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনেক সমস্যা থাকলেও রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালিত হতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার ও দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাই যৌক্তিক কতগুলো সংস্কার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের মূল সমস্যা হলো পারস্পরিক আস্থা না থাকা। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এক দল মনে করে অন্য দল ক্ষমতায় আসলে আমাদের ওপর জুলুম করবে। তাই আমাদের সামনের দিকে এগোতে হলে সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, অতীতে সংস্কার একটি গালিতে পরিণত হলেও সংস্কার এখন বহুল আকাঙ্ক্ষিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমি মনে করি, সংস্কারের আগে আমাদের রাষ্ট্র ভাবনা কেমন হবে তা পরিষ্কার করা উচিত।
আবু সাঈদ খান বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর অনেকগুলো ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে। কিন্তু সংস্কার প্রস্তাবে কতগুলো বিষয়ে বিতর্ক উসকে দেওয়া হয়েছে। যেমন-গণপ্রজাতন্ত্রী শব্দের বদলে নাগরিকতন্ত্র শব্দ প্রস্তাব করা। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানকে বাদ দেওয়া যাবে না। বরং সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এর মধ্যকার কালাকানুন বাতিল করতে হবে।
ড. আসিফ মোহাম্মদ সাহান বলেন, সংস্কারের ব্যাপারে বর্তমানে দেশে একটি জাতীয় ঐকমত্য রয়েছে। সংস্কারের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কিছু কাঠামো পরিবর্তন করা দরকার। যেমন- সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু উচ্চকক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং একে কিছু ক্ষমতা দিতে হবে।
তিনি বলেন, শুধু ভোট দেওয়ার মধ্যে নাগরিকদের সীমাবদ্ধ না রেখে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের যুক্ত করা দরকার। বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবে বিভিন্ন স্বাধীন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন মানে যা ইচ্ছা তা করা নয়। তাই ভবিষ্যতে যে কমিশন ও প্রতিষ্ঠাগুলো গঠিত হবে সেগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সংসদে ১০০ আসনে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারীদের সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হলে নারীরা তাদের কাজের মাধ্যমে মূল্যায়িত হবেন। এতে তাদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন ঘটবে। তাই এ পদ্ধতি প্রবর্তনের ব্যাপারে নাগরিকদের পক্ষ থেকে দাবি তুলতে হবে। একইভাবে পুলিশ বিভাগের সংস্কারের ব্যাপারে নাগরিকদের সোচ্চার হতে হবে।
কেকে/এজে