আর মাত্র কয়েকদিন পরই পবিত্র ঈদুল ফিতর। পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে রাজধানী ঢাকা ছাড়ছেন লাখো মানুষ। বাস, ট্রেন ও লঞ্চে উপচেপড়া ভিড়, টিকিটের জন্য হাহাকার, সড়ক-মহাসড়কে যানজট সব মিলিয়ে উৎসবের আমেজ থাকলেও এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতাও তৈরি হয়েছে। কারণ, ঈদকে কেন্দ্র করে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় প্রকাশ্যে ছিনতাই, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য, বাসে উঠতে গিয়েও পকেটমারের কবলে পড়া এসব ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে।
ঈদের ছুটিতে যখন রাজধানী প্রায় ফাঁকা হয়ে যাবে, তখন চক্রবদ্ধ অপরাধীরা আরও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাসাবাড়ির নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়বে, রাস্তায় কমে যাবে পুলিশের টহল, সাধারণ মানুষও তুলনামূলক কম থাকবে এসবই অপরাধীদের জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি করবে।
গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, ঈদের ছুটিতে ঢাকার বেশিরভাগ মানুষ গ্রামের বাড়িতে চলে যান। তখন রাজধানীর একাংশ পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়। ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা, মার্কেট, আবাসিক এলাকা অনেকটাই জনশূন্য থাকে। এই সময় ফাঁকা বাড়িঘরে চুরির ঘটনা বাড়ে। এরমধ্যে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় চুরির ঘটনা অনেক বেড়ে যায়। এ ছাড়া ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনাও বৃদ্ধি পায়। ফাঁকা রাস্তায় চলাফেরা করা মানুষকে টার্গেট করে ছিনতাইকারীরা। বিশেষ করে রাতের বেলায় রিকশা বা মোটরসাইকেলে চলাচল করা ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। ছিনতাইকারীরা সাধারণত ব্যাগ, মোবাইল, নগদ টাকা, গয়না ইত্যাদি ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। কেউ বাধা দিলে হামলার ঘটনাও ঘটে।
রাজধানীর বাসিন্দারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে দিন-দুপুরে রাস্তায় ছিনতাই, চুরি ও ডাকাতির ঘটনা বেড়ে গেছে। ঈদের ছুটিতে যখন অধিকাংশ মানুষ গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে, তখন ফাঁকা রাস্তায় এসব অপরাধ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নগরবাসী।
রাজধানীর উত্তরার এক ব্যবসায়ী ইমন বলেন, ‘গত কয়েক মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। আমাদের দোকানের কর্মচারীদের কয়েকবার ছিনতাইকারীদের কবলে পড়তে হয়েছে। ঈদে যখন শহর ফাঁকা হয়ে যাবে, তখন এসব অপরাধ আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।’
বনানী এলাকার বাসিন্দা নূরে রোকসানা বলেন, ‘আমার স্বামী রাতে কাজ শেষে বাসায় ফিরতে ভয় পাচ্ছেন। প্রতিদিনই শোনা যায়, ছিনতাইকারীরা ব্যাগ বা মোবাইল টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ টহল থাকলেও অপরাধীরা ধরা পড়ে না।’
মিরপুরের বেসরকারি চাকরিজীবী শাহ আলম বলেন, ‘আমি ঈদে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। কিন্তু বাসায় বৃদ্ধ বাবা-মা থাকবেন। নিরাপত্তার বিষয়ে চিন্তিত। প্রতিবেশীদের বলেছি খেয়াল রাখতে, কিন্তু তাতেও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছি না।’
অন্যদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ইতোমধ্যে ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফাঁকা রেখে যাওয়া নাগরিকদের জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাসাবাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, ব্যাংক-বিমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিপণিবিতানের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রক্ষীদের ডিউটি জোরদার। বাসাবাড়ি ও প্রতিষ্ঠান ত্যাগের আগে দরজা-জানালা সঠিকভাবে তালাবদ্ধ করা। বাসাবাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিপণিবিতানে পর্যাপ্ত সংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা। বাসাবাড়ির মূল দরজায় অটোলক ও নিরাপত্তা অ্যালার্মযুক্ত তালা ব্যবহার করা। রাতে বাসা ও প্রতিষ্ঠানের চারপাশ পর্যাপ্ত আলোকিত রাখার ব্যবস্থা ও অর্থ, মূল্যবান সামগ্রী ও দলিল নিরাপদ স্থানে বা নিকট আত্মীয়ের হেফাজতে রেখে যাওয়া এবং প্রয়োজনে ব্যাংক লকারের সহায়তা নেওয়াসহ আরো কিছু নির্দেশনা। তবে প্রশ্ন হলো এই নির্দেশনা সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা নিশ্চিত কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে?
সাধারণ মানুষের ভাষ্য ঈদের ছুটিতে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। পুলিশের টহল জোরদার করা, বাসাবাড়ির নিরাপত্তার বিষয়ে তদারকি বৃদ্ধি করা এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সাধারণ মানুষ যেন উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, সেটাই সবার কাম্য। ঈদ উৎসব যেন নিরাপত্তাহীনতার কারণে আতঙ্কে পরিণত না হয়, সেদিকে প্রশাসন ও জনগণ সবারই সমানভাবে সচেতন থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
এর আগে গত মঙ্গলবার রাজধানীর রাজারবাগে অবস্থিত বাংলাদেশ পুলিশ মিলনায়তনে ফেব্রুয়ারি মাসের মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, অপরাধ প্রতিরোধে মহানগরের অলিগলিতে নিয়মিত অন্যান্য টহলের পাশাপাশি মোটরসাইকেল টহল আরও বাড়ান হবে। পুলিশি তৎপরতায় ছিনতাইয়ের ঘটনা এখন অনেকাংশে কমে এসেছে। এটি ধরে রাখতে হবে। এ সময় উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আপনাদের আন্তরিক চেষ্টা, মেধা ও অফিসার ম্যানেজমেন্টের কারণে এ সফলতা অর্জিত হয়েছে। সহায়ক পুলিশরাও পুলিশের মতো গ্রেফতার ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। এ ব্যাপারে থানা-পুলিশ তাদের সহায়তা করবে।’
সভায় ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, কয়েক দিনে চিহ্নিত অনেক ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আসন্ন ঈদে গাবতলী ও মহাখালী এলাকায় ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেশি হতে পারে, এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ঈদ উপলক্ষে অনেক বাড়ি ও বিপণিবিতান খালি থাকবে। বিভিন্ন বিপণিবিতানে, বিশেষ করে সোনার মার্কেটগুলোতে পুলিশের টহল বাড়াতে হবে। চুরির ঘটনা প্রতিরোধে আবাসিক এলাকায় রাত্রিকালীন টহল বাড়াতে হবে।
সভায় ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) মো. ফারুক হোসেন ফেব্রুয়ারি মাসের সার্বিক অপরাধ পরিস্থিতি, যেমন ডাকাতি, দস্যুতা, চুরি, খুন, অপমৃত্যু, সড়ক দুর্ঘটনা, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র উদ্ধারসহ বিভিন্ন মামলাসংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করেন।
কেকে/এআর