গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন নিয়ে দেশের রাজনীতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। দলটিকে রাজনীতিতে ফেরানোর চেষ্টার অভিযোগ তুলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সঙ্গে বৈঠকে স্পষ্ট করেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।
এদিকে ড. ইউনূসের এ বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে এনসিপি। গতকাল শুক্রবার রাত আটটায় এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম এ নিন্দা জানান। রাজধানীর বাংলামোটরে রূপায়ন টাওয়ারে এ সংবাদ সম্মেলন হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংঘটিত পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ড, আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড, গুম-ক্রসফায়ার, ভোট ডাকাতিসহ জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রশ্নে কার্যকর অগ্রগতি দৃশ্যমান হওয়ার আগে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পদ থেকে এ ধরনের বক্তব্য অনাকাক্সিক্ষত। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ এখন গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দল নয়, ফ্যাসিবাদী দল। জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার চলাকালীন আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ও জুলাই গণহত্যার বিচারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও এ নিয়ে কঠোর মন্তব্য করেছেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহর দাবি, আওয়ামী লীগকে ফেরাতে ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে নতুন ষড়যন্ত্র চলছে।
গত শুক্রবার রাতে নিজের ফেসবুক পোস্টে হাসনাত আবদুল্লাহ দাবি করেন, ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থনে আওয়ামী লীগকে নতুন করে পুনর্বাসনের একটি পরিকল্পনা চলছে। তিনি লেখেন ১১ মার্চ দুপুর আড়াইটায় ক্যান্টনমেন্টে আমাদের কাছে এ পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। আমাদের প্রস্তাব দেওয়া হয় আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এতে সহযোগিতা করি। হাসনাতের দাবি, এ পরিকল্পনার মাধ্যমে সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরীন শারমিন চৌধুরী ও শেখ ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্বে একটি ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ তৈরির চেষ্টা চলছে। এ দলের নেতারা শেখ হাসিনাকে প্রত্যাখ্যান করবেন, শেখ পরিবারের কিছু অপরাধ স্বীকার করবেন এবং নিজেদের ‘বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ’ হিসেবে জনগণের সামনে তুলে ধরবেন।
তিনি লিখেন, আমাদের বলা হয়, আওয়ামী লীগকে ফিরতে কোনো বাধা দিলে দেশে সংকট সৃষ্টি হবে, আর তার দায়ভার আমাদের নিতে হবে, এতে তিনি স্পষ্ট করেন, তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং আওয়ামী লীগের বিচার চেয়েছেন। হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্যের প্রধান দাবি ছিল আওয়ামী লীগকে চিরতরে নিষিদ্ধ করা। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আমাদের শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত শহিদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। তিনি আরো বলেন, ‘৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কামব্যাকের আর কোনো সুযোগ নেই। বরং দলটিকে অবশ্যই নিষিদ্ধ করতে হবে।
এদিকে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বিচার শেষে জনগণ চাইলেই রাজনীতিতে ফিরতে পারে আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, ‘শুধু শেখ হাসিনার বিচার নয়, আদালতের ন্যায়সঙ্গত বিচার হলে পরে আর ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে না। তখন কে রাজনীতি করবেন বা করবেন না, সেই দায়িত্ব জনগণ নেবে।’
এর আগে ফেসবুক পোস্টে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান জানান, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন মেনে নেবে না জনগণ। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গণহত্যার বিচার ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবকাশও দেখছেন না ডা. শফিকুর রহমান। পোস্টের কমেন্টে জামায়াত আমির লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগের চ্যাপ্টার ৩৬ জুলাই ক্লোজড হয়ে গিয়েছে। নতুন করে ওপেন করার কোনই অবকাশ নেই।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ বলেছেন, আওয়ামী লীগের বিচারের আগে যারা তাদের পুনর্বাসন চায়, তাদের প্রতিহত করা হবে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই বিশেষ সুবিধা পাবে না। গতল শুক্রবার রাজধানীর ভাটারাস্থ আস-সাঈদ মিলনায়তনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগর উত্তরের জরুরি সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেছেন, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করলে আবার অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হবে। বিচারের আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। গতকাল জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে হেফাজতে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ মিছিলে এসব কথা বলেন তিনি। খেলাফত মজলিসের এই নেতা বলেন, বিচারের আগে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নাম নিতে চায় না দেশের মানুষ। আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে হলে দেশের জনগণের রক্তের ওপর দিয়ে যেতে হবে হবে।
আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফেরানোর ইচ্ছা বা পরিকল্পনা বিপজ্জনক বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ভূঁইয়া। গতকাল শুক্রবার দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এ মন্তব্য করেন সরকারের এ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমরা কবে থেকে জার্মানি, ইতালির থেকে বেশি ইনক্লুসিভ ডেমোক্রেটিক হয়ে গেলাম? গণহত্যার বছর না ঘুরতেই আওয়ামী লীগকে ফেরানোর খায়েশ বিপজ্জনক।’
আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীততে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করা পর্যন্ত লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের সংগঠক সারজিস আলম। এ লড়াইকে ‘দ্বিতীয় অধ্যায়’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। শুক্রবার বিকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এ লড়াইয়ে ঘোষণা দিয়েছেন সারজিস আলম। ওই পোস্টে তিনি বলেন, ‘লড়াইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ের জন্য আমরা প্রস্তুত। গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণ পর্যন্ত এ লড়াই চলবে।’
এদিকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও জুলাই গণহত্যার বিচার দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি করেছেন শিক্ষার্থীরা।
এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল পাড়া এলাকা থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এসে এক বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সমাবেশে এবি জুবায়ের বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কাজ ছিলো জুলায় হত্যাকাণ্ডের বিচার করা, কিন্তু তারা তা করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে গণভোটের আয়োজনের আহ্বান করেন তিনি।’ বক্তব্য শেষে ‘গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ মঞ্চ’ নামে একটি প্লাটফর্মের ঘোষণা দেন জুবায়ের।
কেকে/এআর