সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং জঙ্গিবাদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে আমেরিকা এবং ভারতের যৌথ চাপের মুখে ঢাকা। ভাবমূর্তি উদ্ধারের লক্ষ্যে এপ্রিলের গোড়ায় ব্যাঙ্ককে বিমসটেক সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদি এবং মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে একটি পার্শ্ববৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা। বিষয়টি নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি নয়াদিল্লি।
সাউথ ব্লকের সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, “প্রত্যেক দিন গালি দেওয়া হবে, আবার বৈঠকও হবে, দুটি বিষয় কী করে একসঙ্গে চলতে পারে? এখনো পর্যন্ত এ বৈঠক হওয়া খুবই কঠিন বলে মনে হচ্ছে। তবে এখনো দু’সপ্তাহ বাকি। এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটতে পারে। এখনই চূড়ান্ত কথা বলা যাচ্ছে না।”
২০ মার্চ প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়। এতে আরো বলা হয়, সাউথ ব্লক সূত্রের বক্তব্য, বিষয়টি নিয়ে সরকারের নিজের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকের একটা বড় অংশ মনে করছে, আলোচনার প্রস্তাব একেবারে প্রত্যাখ্যান করা হলে সে দেশে ভারত-বিরোধিতা আরো বাড়তে পারে কি না, তা আগে খতিয়ে দেখা হোক। সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন কমাতে ইউনূসকে চাপ দেওয়া যেতে পারে এক টেবিলে মুখোমুখি বসে। চীন এবং পাকিস্তান যেভাবে ভারত-বিরোধী প্রভাব তৈরি করতে ঢাকাকে ব্যবহার করছে, তাকেও প্রশমিত করা সম্ভব। পাশাপাশি ভারতের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার মনোভাব, বাংলাদেশ চাইল বলেই বসে যাওয়ার মতো কোনো কারণ ঘটেনি। তারা ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে নিয়মিত। সাউথ ব্লকের দেওয়া নাশকতা এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি হিংসার কোনো তথ্যই মানতে চাইছে না। এখনো আলোচনার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি।
সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং জঙ্গিবাদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধান তুলসী গাবার্ড দিল্লিতে এসে যে ভাষায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তাতে যথেষ্ট চাপে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। উপমহাদেশে ভারতকে অস্বস্তিতে ফেলতে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে দহরম মহরম বাড়াচ্ছে মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার, ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, সরকারের রাশ আসলে মৌলবাদী স্বাধীনতা-বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর হাতে। তুলসী গাবার্ড কড়া ভাষায় উদ্বেগ প্রকাশের পরে এবার ভাবমূর্তি উদ্ধারে এ সরকার কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে। কিছু জঙ্গিকে আটক করা এবং ভুয়া মামলায় কারাবন্দি বিপক্ষের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে ঈদের আগে সরকার জামিনে মুক্তি দিতে পারে বলে খবর ঘুরছে ঢাকায়।
ইউনূস সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বাংলাদেশে ‘সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কবর দিয়ে’ আফগানিস্তানে তালেবানের ধাঁচে খিলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিতে সরব হয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর ও কয়েকটি মৌলবাদী সংগঠন। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও পুলিশের সামনেই তারা ঢাকার রাস্তায় নিয়মিত সমাবেশ ও সাংবাদিক বৈঠক করছে। কোথাও কোথাও তাদের কর্মসূচিতে পুলিশি পাহারাও দেখা গিয়েছে। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানও সম্প্রতি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তাদেরও আসল উদ্দেশ্য বাংলাদেশে ইসলামি শাসন চালু করা। তুলসী এ বিষয়টি উল্লেখ করে বলছেন, জঙ্গিদের এই খিলাফত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ভারত, বাংলাদেশ, সিরিয়া, আমেরিকাসহ গোটা বিশ্বের কাছে একটা উদ্বেগের কারণ হয়েছে। তিনি বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আপসহীন।”
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের পাশাপাশি মোদি-ইউনূস বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছিল ঢাকা। কিন্তু তা হয়নি। নয়াদিল্লি জানিয়েছিল, নিউইয়র্কে একই সময়ে গেলেও মোদি সাধারণ পরিষদে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেননি, করেছিলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। মোদি গিয়েছিলেন কোয়াড-এর শীর্ষ বৈঠকে। সেই সফরে ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের সময় বের করা সম্ভব নয়। এর পরে জয়শঙ্কর বাংলাদেশের বিদেশ উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিমসটেকে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হোক বা না হোক, ইউনূস মঙ্গলবার বলেছেন “কক্সবাজারে প্রস্তাবিত একটি বন্দর হলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও পণ্য পাঠানো হবে।’ এতদিন উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার হুঙ্কার দিয়েছে তার কিছু উপদেষ্টা ও অনুগত ছাত্রনেতা। এই প্রথম সদর্থক কথা বললেন ইউনূস।
তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এদিন নিয়মিত সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, “ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো চলছে।” তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের এই ৭ মাসে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য আরো বেড়েছে। তবে ভিসার বিষয়ে কিছু জটিলতা আছে। সে বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। কিন্তু আমরা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই।” শফিকুল অবশ্য ২৬ মার্চ ইউনূসের চীন সফরের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়েই ভারতের বিষয়টি তোলেন।
হিন্দুস্তান টাইমস বৈঠকের সম্ভাবনা দেখছে না
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আগামী মাসে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলনে দেখা হতে পারে। কিন্তু তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে যে বৈঠকের কথা বলা হচ্ছে, সেটি নাও হতে পারে। বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছেন। ভারতের সংবাদ মাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস এমন খবর জানিয়েছে।
আগামী ৩ থেকে ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হবে। এ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন মোদি ও ড. ইউনূস। সম্মেলনের এক ফাঁকে মোদি ও ইউনূসের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠকের জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ভারতকে চিঠি দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার তিনি এ তথ্য জানান। একটি আঞ্চলিক সম্মেলনে মোদি ও ইউনূসের উপস্থিত থাকার ঘটনা এবারই প্রথম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিন ব্যক্তি হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে তাতে শীর্ষ পর্যায়ে দুই নেতাদের মধ্যে বৈঠক হওয়ার পরিস্থিতি নেই। তারা আরো বলেন, বিশেষ করে সম্পর্কের টানাপোড়েন ও বিরোধের প্রেক্ষাপটের কারণে বৈঠকের উপযুক্ত পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি।
একটি সূত্র হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেছেন, ‘সম্মেলনে যেহেতু বিশ্ব নেতারা একাধিকবার একে-অপরের সামনে আসবেন। তখন হয়তো (ড. ইউনূস-মোদির মধ্যে) কথাবার্তা হলেও হতে পারে। কিন্তু এর বেশি কিছু প্রত্যাশা করা হচ্ছে না।’
অপর সূত্রটি বলেছেন, ‘আনুষ্ঠানিক বৈঠক আয়োজন কঠিন মনে হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার কাছ থেকে প্রতিদিনই ভারতের বিরুদ্ধে নতুন সমালোচনা আসছে। এসব বিষয় বৈঠক আয়োজনের ক্ষেত্রে সহায়ক নয়।’
বঙ্গোপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার (বিমসটেক) দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড।
ড. ইউনূস-মোদির বৈঠক পরস্পরবিরোধী খবর বাংলাদেশে
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য ভারতকে কূটনৈতিক চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। গত বুধবার এ চিঠি পাঠানো হয়।
এদিকে ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআইকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ‘বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে আমাদের দুই নেতার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে আমরা ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ করেছি’।
বিশেষ করে সাবেক স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া এবং সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ তোলায় দিল্লির সঙ্গে ঢাকার তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হয়। গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইলেও এখনো তাকে ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো জবাব দেয়নি ভারত। যা সম্পর্কে আরো প্রভাব ফেলেছে।
কেকে/এআর