সব মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত বৃহস্পতিবার হত্যা মামলা থেকে দায়মুক্তির উদ্দেশে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে করা মামলা থেকে তারেক রহমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আটজনকে খালাস দিয়েছেন আদালত। এর মধ্য দিয়ে বিচারিক আদালতে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা রইল না। সেইসঙ্গে তারেক রহমানের দেশে ফেরার বাধা কেটে গেল।
এক এগারো সরকারের সময় থেকে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দেশি বিদেশি প্রোপাগান্ডা চালানো হয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা বিএনপি ও জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করতে সুপরিকল্পিত ও ধারাবাহিকভাবে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা ন্যারেটিভ তৈরি করে। আর তাদের এ কাজে বাংলাদেশের কিছু বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া ও ভারত সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখে।
২০০১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। এরপর থেকেই তারেক রহমানকে টার্গেট করা হয়। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় নানা সময়ে। বিশেষ করে হাওয়া ভবন, খাম্বা দুর্নীতি, পরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড মামলায় জড়ানো হয় তাকে।
সেনাসমর্থিত এক এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একাধিক দুর্নীতির মামলা থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে বাংলাদেশ ছাড়েন তারেক রহমান। সেখানে তিনি পরিবারের সঙ্গেই থাকছেন। দেশ ছাড়ার সময় তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে পরে তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে দলের নেতৃত্বের ভূমিকায় ফেরেন।
খালেদা জিয়া ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেকের বিরুদ্ধে এক-এগারো সরকার এবং পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় ৮৫টি মামলা দায়ের করেছিল। তার আইনজীবী ব্যারিস্টার জাকির হোসেন বলেন, এক-এগারো সরকার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তারেকের বিরুদ্ধে প্রায় ৮৪-৮৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিছু বড় মামলার মধ্যে রয়েছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, অবৈধ সম্পত্তির মামলা, সিঙ্গাপুর মানিলন্ডারিং মামলা, নড়াইলে মানহানির মামলা এবং ঢাকার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। এ ছয়টি মামলায় তারেক রহমানকে সাজা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আপিল বিভাগ সবকটিতেই তার পক্ষে রায় দিয়েছেন।
জাকির হোসেন আরো বলেন, এই ছয়টি মামলা বাদে ৫ আগস্টের পর অন্যান্য মামলার অভিযোগপত্র খারিজ করা হয়েছিল। বাকি মামলাগুলো হয় হাইকোর্ট খারিজ করে দিয়েছিলেন অথবা স্থগিত করেছিলেন। বিভিন্ন জেলায় দায়ের করা এই মামলাগুলোতে নাশকতা, চাঁদাবাজি এবং মানহানির অভিযোগ ছিল।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগ ছিল খাম্বা দুর্নীতি। কিন্তু বানোয়াট খাম্বা দুর্নীতিকে পুঁজি করে তারেক রহমানের নামে একটি মামলাও করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে বর্তমান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট মন্তব্য করেছিলেন, বিএনপি আমলে খাম্বা ব্যবসাটা মূলত কাজী শাহেদের হলেও তার কোনো বদনাম হয়নি, হয়েছে তারেক রহমানের।
এদিকে আওয়ামী লীগের দালাল ও ভারতের প্রেসক্রিপশনে গড়ে ওঠে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিস্টার টেন পার্সেন্ট ন্যারেটিভ। কিন্তু এ ন্যারেটিভের পক্ষে একটি প্রমাণ আজ পর্যন্ত কেউ হাজির করতে পারেনি। এ ছাড়া ২০০৭ সালের ৯ এপ্রিল ১০ কোটি টাকা চাঁদার দাবির অভিযোগে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে আবদুল মোমেন লিমিটেড। ২০২৪ সালে এসে জানা যায়, সে বছরই, অর্থৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৭ মে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করে বাদীপক্ষ। কারণ ‘বিশেষ মহলের চাপে’ পড়ে মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আমিন আহমেদ ভুঁইয়া মানের এক ব্যবসায়ী ১/১১ সরকারের শাসনামলে তারেক রহমান আটক হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তার নামে এক কোটি টাকার চাঁদাবাজির মামলা করেন। পরে ওই সরকারের আমলেই সংবাদ সম্মেলন করে মামলার প্রত্যাহারের কথা জানান তিনি। তিনি আরো জানান, তাকে বাধ্য করা হয়েছিল এ মামলা করার জন্য।
তারেক রহমানের নামে করা মিথ্যা অভিযোগগুলো ছিল মাইনাস টু বাস্তাবায়নে ব্যস্ত ডিজিএফআইয়ের দেওয়া নিউজ। পরে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম স্বীকার করেন, সে কাজটি ছিল তার এডিটোরিয়াল জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এ ছাড়া হারবিন কোম্পানির দুর্নীতির মামলায় হাসিনার আমলেই বেকসুর খালাস পান তারেক রহমান। প্রাণনাশের আশঙ্কায় বিচারক পরবর্তীকালে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এক এগারো সময়কার মামলাগুলো প্রসঙ্গে এনবিআরের এক সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছিলেন, তারেক রহমানের নামে কোনো অ্যাসেট নাই, তার বিরুদ্ধে কোনো কিছুই প্রমাণিত হয়নি। (এক এগারো, মহিউদ্দিন আহমেদ, পৃষ্ঠা ২৭৪) ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে ন্যাবিচারের পথ সুগম হয়। এরপর একেপর এক মামলা থেকে তারেক রহমান খালাস পান। বর্তমানে বিচারিক আদালতে তার নামে আর কোনো মামলা নেই। এরপর থেকেই তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে গুঞ্জন ওঠে। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন, সে দিনক্ষণ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারণ করিনি। আমাদের যখন মনে হবে উপযুক্ত সময়, সে সময় তিনি (তারেক রহমান) আসবেন।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যত মামলা ছিল তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৭টি মামলা হয়েছে। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা সরকারের সময় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, অর্থ-পাচার এবং দেশব্যাপী মানহানির মামলাসহ আরো অন্তত বিশটির বেশি মামলা হয়। এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মামলা, অর্থপাচার মামলা, মানহানির একাধিক মামলা, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একাধিক মামলা হয়েছিল।
কেকে/ এমএস