রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বাস্তবায়ন-৬ এর অধীনে উত্তরার সোনারগাঁও জনপদের ১১ ও ১৩ সেক্টরের উভয় পাশে কয়েক হাজার কোটি টাকা মূল্যের বাণিজ্যিক প্লট বছরের পর বছর ধরে বেদখল হয়ে আছে। প্রায় শত কোটি টাকা মূল্যমানের অন্তত ২০টি বাণিজ্যিক প্লট ২০১৩ সাল থেকে দখলে রেখেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে হাইকোর্টের একটি আদেশ। তবে হাইকোর্টের সেই আদেশগুলোর সত্যতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের তথ্যমতে, ২০১৩ সালের দিকে উত্তরার সোনারগাঁও জনপদ সড়কের ১১ ও ১৩ নং সেক্টরে দুই পাশে অন্তত ৫০টি বাণিজ্যিক প্লট পরিত্যক্ত থাকায় সেখানে বিভিন্ন রকম বস্তি বাড়ি গড়ে ওঠে। ২০১৪ সালে বিজয় মেলার নামকরণ করে প্রথমে সাত থেকে আটটি প্লটে মেলার আয়োজন করে তৎকালীন যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ। এক মাসের সেই মেলাটি সময় গড়িয়ে এক বছর পেরোয়। একপর্যায়ে তৎকালীন উত্তরার হরিরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত আবুল হাশিম ঘটনাস্থলে এসে সেই মেলা উচ্ছেদ করেন। পরবর্তী সময় ধারাবাহিকভাবে দখল হতে থাকে একের পর এক প্লট।
তৎকালীন সময়ে চেয়ারম্যানপুত্র প্রয়াত জাহিদুল হাসান ও নাজমুল হাসান দুই ভাই দখলে নেন উত্তরা ১১নং সেক্টর সোনারগাঁও জনপদ সড়কের ৮০ ও ৮২ নম্বর প্লট দুটি। সে সময়ের চেয়ারম্যান পরিবারকে জড়িয়ে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে এ দুটি প্লটের দায়িত্ব নেয় বাপ্পি এবং জামাই ইউনুস নামে দুই ব্যক্তি। ৫ আগস্ট পরবর্তী হত্যা মামলার আসামি যুবলীগ নেতা জামাই ইউনুস পালিয়ে গেলে তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্লটটিও বাপ্পি দখলে নেয়। আবার ৮৪ নম্বর প্লটটিও দখলে রয়েছে এই বাপ্পির। এই প্লটটির সামনে হাইকোর্টের একটি স্ট্রে অর্ডারের সাইনবোর্ড ঝোলানো রয়েছে, স্থগিতাদেশ থাকা অবস্থায় স্টিল স্ট্রাকচারের মাধ্যমে দুইতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন বাপ্পি।
প্লটের প্রকৃত মালিকানা ও স্ট্রে অর্ডার থাকা অবস্থায় সেই প্লটে নির্মাণ কাজ করা যায় কিনা এই বিষয়ে জানতে চাইলে প্লটের বর্তমান দখলদার বাপ্পি খোলা কাগজকে বলেন, ‘৮৪ নম্বর প্লটটি আমার স্ত্রীর নামে বরাদ্দ পাওয়া। এই বিষয়ে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে, ৮০/৮২ নম্বর প্লট দুটি আমার নয়।’
এদিকে উত্তরার প্রভাবশালী বিএনপি নেতা ও সরকার বিল্ডার্স ডেভলপমেন্ট লি. (এসবিডিএল)-এর স্বত্বাধিকারী আব্দুস সালাম সরকারের দখলে রয়েছে ১৩নং সেক্টরে অবস্থিত ৭৯ এবং ৮১ নং প্লট দুটি।
এই প্লটগুলোর মালিকানায় তার বৈধ কোনো কাগজপত্র রয়েছে কিনা জানতে চাইলে আব্দুস সালাম সরকার দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, ‘জি¦, এই প্লটগুলো আমাদের, এর ভাড়া আমিই নিচ্ছি।’ রাজউকের বরাদ্দ পাওয়া প্লটে প্লান পাশ করিয়ে ইমারত নির্মাণ ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়া যায় কিনা ও প্লটগুলো আপনার নামে রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে উনার অফিসে দেখা করতে বলেন।
আবার ৫৯/৬১/৬৩ ও ৬৫ নং এই চার প্লটের একক মালিকানা দাবি করছেন ওমর ফারুক দিপু নামে এক ব্যক্তি। ২০১৬ সালে ৫৯ ও ৬১ এই দুটি প্লটে উত্তরা মডেল টাউন কাঁচাবাজার স্থাপন করেন। সেসময় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা জামানত হিসেবে গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তৎকালীন রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জেসমিন আক্তার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে বাজারটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন। সেসময় জামানতের টাকা ফেরত চেয়ে ব্যবসায়ীরা দিপুর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন, যেই মামলায় দীপু জেলও খেটেছেন বলে প্রতিবেদকের কাছে তথ্য রয়েছে। কোটি কোটি টাকা মূল্যের এ ধরনের চারটি প্লটের একা মালিক হওয়া দ্বীপু শেখ হেলালের আত্মীয় বলে জানা গেছে। এ ছাড়া দেশের আরো বেশ কয়েকজন ভূমিদস্যুর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন একাধিক সূত্র।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার আমলেই পাঁচ কোটি টাকার প্রতারণা মামলায় গ্রেফতার হয়ে আবারো বেরিয়ে আসেন তিনি, জেল থেকে বেরিয়ে আবারো সেই প্লটগুলো থেকে ভাড়া আদায় করতে থাকেন দিপু। এদিকে ৬৩ এবং ৬৫ নং এই দুটি প্লটের দখলে ছিল উত্তরা পশ্চিম থানার তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি শাকিল উজ জামান বিপুল। এই দুটি প্লট থেকে প্রতিমাসে অন্তত সাড়ে সাত লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন বিপুল। বর্তমানের সেই প্লট দুটো ওমর ফারুক দিপুর দখলে রয়েছে।
ওমর ফারুক দিপুর প্লটে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে প্রতিটি দোকানের ভাড়া ছিল ৬০ হাজার টাকা। ৫ আগস্ট পরবর্তী সেই দোকানের ভাড়া বাড়িয়ে এখন এক লাখ বিশ হাজার টাকা করা হয়েছে। সেই হিসেবে ওমর ফারুক দীপুর চারটি প্লটে ২৮টি দোকান রয়েছে, যা থেকে প্রতিমাসে ভাড়া উত্তোলন করা হয় প্রায় অর্ধকোটি টাকা। সেইসঙ্গে আবারো নতুন করে চুক্তিপত্র করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ওপর। আগে ১০ কাঠার দুটি প্লটে মোট ২০ কাঠা খালি জমি ১৫ লাখ টাকা জামানত ও মাসিক দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা হিসেবে তাইজুল এন্টারপ্রাইজের কাছে ভাড়া দিয়ে ছিলেন ওমর ফারুক দিপু। সেই আলোকে জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত ভাড়াও পরিশোধ করেছেন তাইজুল আসলাম। যার রশিদ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। এ চারটি প্লটের কোনো বৈধ কাগজ আছে কিনা ও ব্যবসায়ীদের থেকে জামানত বাবদ পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ বিষয়ে জানতে ওমর ফারুক দিপুর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
এদিকে ৫৭ এবং ৭৫ নম্বর প্লটটির দখলদার মালিক ছিলেন সাবেক এমপি হাবিব হাসানের ভাগিনা কবির হাসান, তখন থেকেই কবির হাসানের হয়ে প্লট দুটির ভাড়া উঠাতেন হযরত নামে এক ব্যক্তি। বর্তমানেও এই প্লট দুটির ভাড়া হযরত উঠাচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে হযরতের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
১১ নং সেক্টরের ৪৮নং প্লটটি দখলে রয়েছে শান্ত নামে এক বিএনপি নেতার। তিনি সেই প্লটে তাঁত ও বস্ত্র মেলার আয়োজন করেছেন। ঈদের আগে সেই মেলা চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে শান্তর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসেভ করেননি।
৫০নং প্লটিটির মালিকানা দাবি করে সেই প্লটে দোকান বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন মোহাম্মদ আলী নামের এক ব্যক্তি। সেই প্লট থেকেও প্রতিমাসে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন তিনি। আবার ৪৭, ৫৪, ৮০ ও ৮২ নং প্লটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, উনারা কাউকে ভাড়া দেন না। তবে বিএনপির প্রভাবশালি এক নেতার নাম বলে কয়েকটি গ্রুপ ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
১১নং সেক্টরের ৭৪ নং প্লটটির দখলে রয়েছেন মো. শাহীন নামের এক ব্যক্তি, যা পূর্বে ৫১নং ওয়াড কাউন্সিলর শারিফুর রহমানের লোকজন ভাড়া উঠাতেন। আবার ২৯নং প্লটে কয়েকটি খাবার হোটেল হিসেবে ভাড়া দিয়েছিলেন ৫১ নং ওয়াড কাউন্সিলরের বিশ্বস্ত ও সেচ্ছাসেবকলীগ নেতা খোকন ও জহির।
রাজউকের হাজার কোটি টাকা মূল্যের প্লট দখল বিষয়ে (বাস্তবায়ন-৬) এর নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ মো. গোলাম রাব্বির কাছে জানতে চাইলে তিনি খোলা কাগজকে বলেন, অবৈধ প্লটগুলোতে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কারোর নামে প্লট বরাদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেই বরাদ্দ গৃহীতে প্লট বুঝিয়ে দিচ্ছি। বেআইনিভাবে দখলে রাখা প্লটগুলো অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে উচ্ছেদ করে নিজ দখলে নেবে রাজউক। মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি স্টেট শাখার বিষয়, কোন কোন প্লটে মামলা রয়েছে তা উনারাই বলতে পারবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কেকে/এআর