সাম্প্রতিক জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি) সমন্বয়হীনতা ও নেতৃত্বের অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দলের শীর্ষ নেতাদের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্কিত পোস্ট রাজনৈতিক অঙ্গনে জন্ম দিয়েছে ব্যাপক সমালোচনা।
বিশেষ করে সেনাপ্রধানকে নিয়ে এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, আব্দুল হান্নান মাসউদ ও নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারীর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে দলের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি আরো প্রকাশ্যে এসেছে। সেনাপ্রধানকে নিয়ে হাসনাতের দেওয়া বক্তব্যকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সে বৈঠকে উপস্থিত থাকা আরেক নেতা সারজিস আলম। পরে তাদের দুজনের মন্তব্যের পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানান হান্নান মাসউদ।
এর আগে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহিদ জিয়াউর রহমানকে নিয়ে এনসিপি নেতা নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারীর একটি ফেসবুক পোস্ট দলীয় নেতাকর্মীসহ ফ্যাসিবাদরিবোধী রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত তিনি স্ট্যাটাসটি মুছে ফেলতে বাধ্য হন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘটনা এনসিপির অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা ও নেতৃত্বের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করছে। দলটির নেতারা নিজেদের অবস্থান ও বক্তব্য ঠিকভাবে সমন্বয় করতে না পারায় একের পর এক বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। এর ফলে পারস্পরিক দূরত্ব বাড়ছে এবং দলীয় ঐক্য প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, যা এনসিপির ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।
জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বিরুদ্ধে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের জন্য ‘চাপ’ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। পাশাপাশি ১১ মার্চ সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহর দেওয়া ফেসবুক পোস্টের কিছু অংশের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন তিনি।
গতকাল রোববার এক ফেসবুক পোস্টে সারজিস আলম জানান, ওই দিন সেনানিবাসে তাদের ডেকে নেওয়া হয়নি বরং সেনাপ্রধানের মিলিটারি অ্যাডভাইজারের সঙ্গে বার্তালাপের মাধ্যমে যোগাযোগ হতো। ১১ মার্চ সেনাপ্রধান পিলখানা হত্যাকাণ্ড দিবসে ‘এনাফ ইজ এনাফ’ মন্তব্য করার পর, সারজিস আলম মিলিটারি অ্যাডভাইজারের সঙ্গে কথা বলেন এবং সেনাবাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চান। এরপরই তাদের সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তবে সাক্ষাতে হাসনাত ও সারজিস ছাড়াও তাদের দলের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও ব্যক্তিগত কারণে তিনি যেতে পারেননি।
ওই বৈঠকে সেনাপ্রধান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বক্তব্য দেন। তবে, সারজিস আলমের মতে এটি কোনো প্রস্তাব ছিল না। বরং সরাসরি মতামত প্রকাশের মতো ছিল।
সারজিস লেখেন, হাসনাতের দেওয়া ফেসবুক পোস্টে আলোচনার কিছু অংশ অতিরঞ্জিত হয়েছে। আলোচনায় রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ, সাবের হোসেন, শিরীন শারমিন চৌধুরী ও সোহেল তাজসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা-না করা, এর সম্ভাব্য প্রভাব, স্থিতিশীলতা ও অস্থিতিশীলতা নিয়ে কথোপকথন হয়। তবে, সারজিস মনে করেন, এটি কোনো একতরফা চাপ দেওয়ার আলোচনা ছিল না, বরং সেনাপ্রধান আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন।
হাসনাতের পোস্টে উল্লেখিত সেনাপ্রধানের এক মন্তব্য, যেখানে তিনি বলেছেন- ‘ইউ পিপল নো নাথিং। ইউ ল্যাক উইজডম অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স। উই আর ইন দিজ সার্ভিস ফর অ্যাট লিস্ট ফোর্টি ইয়ার্স। তোমার বয়সের থেকে বেশি,’ সেটি সত্য হলেও, সারজিসের মতে, এটি রাগান্বিত সুরে বলা হয়নি। বরং এটি একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে জুনিয়রদের প্রতি পরামর্শমূলক ছিল।
সারজিস আরো বলেন, ‘হাসনাত না ওয়াকার’ এই ন্যারেটিভ বা স্লোগান আমি সমর্থন করি না। সেনাপ্রধানের পদত্যাগের যে দাবি উঠেছে, সেটিও আমাদের দল থেকে আসেনি। সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান তৈরি করাও প্রাসঙ্গিক নয়।’
সারজিস আলম মনে করেন, সেনাপ্রধানের সঙ্গে হওয়া আলোচনার বিষয়ে তাদের দলীয় ফোরামে আলোচনা করা উচিত ছিল। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজপথে নামা যেতে পারত। কিন্তু, ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে এটি প্রকাশ করাকে তিনি সমীচীন মনে করেন না। এর ফলে ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাগুলোতে আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে। এ সময় তিনি স্পষ্ট করেন, হাসনাতের সঙ্গে তার মতপার্থক্য থাকলেও, তাদের লড়াই একসঙ্গে চলবে। তারা হাসিনা সরকার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, ভবিষ্যতেও আওয়ামী লীগের যে কোনো সংস্করণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।
আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের চেষ্টা নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির দুই শীর্ষ নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমের দুই রকম কথার পরিপ্রেক্ষিতে ‘সরি আর চুপ থাকতে পারলাম না’ বলে মন্তব্য করেছেন দলটির আরেক শীর্ষ নেতা আবদুল হান্নান মাসুদ। সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে দেওয়া সারজিসের পোস্টে কমেন্ট করে এ মন্তব্য করেন হান্নান মাসুদ। হান্নান লিখেছেন, ‘এসব কি ভাই! পাবলিকলিই বলছি দুজনের একজন মিথ্যা বলছেন। এটা চলতে পারে না। আর দলের গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট হোল্ড করেও আপনারা যেভাবে ব্যক্তিগতভাবে বিচরণ করছেন এবং তা পাবলিক করে এনসিপিকেই বিতর্কিত করছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘মানুষ এনসিপিকে নিয়ে যখন স্বপ্ন বুনছে, তখন এভাবে এনসিপিকে বিতর্কিত করার কাদের এজেন্ডা! সরি, আর চুপ থাকতে পারলাম না।’
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার ফেসবুকে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে এক পোস্ট দেন হাসনাত আবদুল্লাহ। সেখানে তিনি আওয়ামী লীগকে ‘ক্যান্টনমেন্ট’ থেকে পুনর্বাসন চেষ্টার অভিযোগ করেন। এদিকে হাসনাত আব্দুল্লাহর দেওয়া ফেসবুক পোস্টকে ‘অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ব গল্পের সম্ভার’ বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নেত্র নিউজকে জানায় সেনাবাহিনী সদর দফতর।
কেকে/এআর