জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করেছে আওয়ামী লীগ।
একইসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের পদত্যাগ নিয়েও নানা অপপ্রচার চালায় তারা। কখনো কখনো পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ফিরে আসা নিয়ে গুজব ছড়ানো হয় ফেসবুক, ইউটিউবসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভারতে অবস্থানরত পলাতক আওয়ামী লীগের বেশ কিছু শীর্ষ নেতা ২৬ মার্চ ঘিরে দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রোপাগান্ডাও ছড়ানো হয়েছিল। তবে সম্প্রতি সেনা সদরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে আওয়ামী লীগের ‘সংশোধিত’ একটি পক্ষের রাজনৈতিক পুনর্বাসনে রাজি হতে সেনানিবাস থেকে চাপ পাওয়ার বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ দাবি করেন। এ বিষয়টি নিয়ে সেনাবাহিনী প্রধানকে সরানোর গুজব ছড়ায় আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া ভারতের প্রথম সারির বেশ কিছু গণমাধ্যমও ব্যাপকহারে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্য নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তুলসী গ্যাবার্ডের দিল্লি সফরে সেখানকার মিডিয়ায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থার উত্থান, সন্ত্রাসবাদের হুমকি, সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে এনেছেন। বিষয়টিকে উপলক্ষ করে দেশের অভ্যন্তরে নানান প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করছে।
এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রধানকে সরানোর বিষয় নিয়ে ‘গুজব ছড়ানো হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। গত শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে রংপুর বিভাগ রিপোর্টার্স ফোরামের (আরডিআরএফ) ইফতার মাহফিলে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীকে প্রতিপক্ষ করার কোনো সুযোগ নেই। সেনাবাহিনীর প্রধানকে সরানোরও কোনো প্রশ্ন কখনো আসেনি। বরং এ নিয়ে ‘গুজব ছড়ানো হচ্ছে’।
সারজিস আলম বলেন, আমরা একটি বিষয় স্পষ্ট করি। আমরা মনে করি যে, সেনাবাহিনী এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠানের ওপর আমাদের সবার আস্থা আছে। এ শ্রদ্ধাবোধ আমাদের সবারই আছে। আমরা এটা হারাতেও চাই না। সেনাবাহিনী যে প্রতিষ্ঠানটি, জাতীয় নাগরিক পার্টির জায়গা থেকেও আমি আমার ব্যক্তিগত জায়গা থেকেও যদি বলি, আমরা তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধটি ছিল এবং আমরা এটা রাখতে চাই। তিনি বলেন, এখানে জনগণের সঙ্গে কিংবা জাতীয় নাগরিক পার্টির সঙ্গে কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো সঙ্গে সরাসরি সেনাবাহিনীকে প্রতিপক্ষ করার কোনো সুযোগ নেই।
এর আগে চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে’ বলে অভিযোগ করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, দেশ থেকে স্থানান্তর হওয়া টাকা ফিরিয়ে এনে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। তাদের কঠোর হাতে দমন করা হবে। রোববার দিবাগত রাত ৩টা ৫ মিনিটের দিকে বারিধারা ডিওএইচএসের নিজ বাসায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে এমন মন্তব্য করেন উপদেষ্টা।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর প্রথমেই গুজব ছড়ানো হয় ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে জনতা’। অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে শহিদ মিনারে জমায়েতের পুরনো ভিডিওচিত্র। তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা গুজব হিসেবে চিহ্নিত হয়। এরপর থেকে নানা অপপ্রচার ও গুজব দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও অনলাইন আওয়ামী লীগ নামে বেশ কয়েকটি গ্রুপের মাধ্যমে গুজব ছড়াতে দেখা যায়। যদিও গুজব ও অসত্য তথ্য যাচাইকারী সংশ্লিষ্ট পেজ ‘রিউমার স্ক্যানার’ মাধ্যমে এসব গুজবের আসল তথ্য বের করা সম্ভব হয়।
সম্প্রতি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. ইউনূস পদত্যাগ করেছেন’ এমন গুজব ছড়ানো হয়। দুটি নকল পদত্যাগপত্র ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতে হাস্যরসেরও সৃষ্টি হয়।
পরে নোয়াখালীর চাটখিলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের পদত্যাগের গুজব শুনে শোডাউন করায় দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত ২৪ জানুয়ারি রাত ৮টার দিকে উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের বানসা বাজার থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, ফেসবুকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের পদত্যাগের গুজব শুনে শুক্রবার রাতে উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের বানসা বাজারে শোডাউন করে যুবলীগের একদল নেতাকর্মী। এতে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। একপর্যায়ে স্থানীয়দের সহায়তায় দুজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
অনেক সাধারণ নাগরিকের ধারণা, সদ্য ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ দেশে জনমত তৈরি করতে পারছে না। তাই কিছুটা গুজব নির্ভর হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে পুরোনো কায়দায় তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঠে নামানোর চেষ্টা হচ্ছে। নেতাকর্মীরা মাঠে নামলে তা যদি সংঘর্ষে রূপ নেয় তাহলে সংষর্ষের সেসব তথ্য জাতিসংঘে উপস্থাপন করে বিশ্বে নিজেদের নিপীড়িত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় আওয়ামী লীগ।
সাধারণ নাগরিকরা বলছেন, এ লক্ষ্যে এরইমধ্যে আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে জানানো হয়েছে, দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর ঘটে যাওয়ার হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা জাতিসংঘের কাছে তুলে ধরতে চান তারা।
প্রোপাগান্ডার রাজা ভারতের মিডিয়া : মিথ্যা তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানোর ক্ষেত্রে ভারত শীর্ষে রয়েছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার), ইউটিউবের মতো সোশ্যাল প্লাটফর্মের পাশাপাশি ‘রিপাবলিক বাংলা’র মতো কথিত গণমাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়েছিল ভারতের মিডিয়াগুলা। কিন্তু দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এ অপপ্রচারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে অন্য গণমাধ্যমগুলোও।
এমনকি ভারতের যেসব গণমাধ্যমকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘দায়িত্বশীল’ মনে করা হতো, তাদেরই এ ধরনের ভুল সংবাদ প্রচারে নেমে যেতে দেখা গেছে। যেমন- মুজিবের ভিটায় তালেবানি ফতোয়া, বাজারে যেতে পারবেন না মহিলারা’- এমন শিরোনামে গত দুদিন ধরে প্রোপাগান্ডা ছড়ায় ভারতীয় মিডিয়াগুলো। টুঙ্গিপাড়ার গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মেলায় স্বেচ্ছাসেবীদের শৃঙ্খলারক্ষা ও গণজমায়েত এড়াতে দেওয়া এক ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক তুলছিল ভারতীয় সাংবাদিকরা।
কেকে/এআর