সারা বছরজুড়ে জুতা সেলাইয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন ধনেশ্বর চন্দ্র রবিদাস (৫০)। উৎসব আসলে তার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। কারণ উৎসবকে ঘিরে তাকে তৈরি করতে হয় নতুন পাদুকা। ঈদ-উল ফিতর, ঈদ-উল আযহা ও দূর্গাপুজার সময় নতুন পাদুকা তৈরি ও বিক্রি করে বাড়তি আয় করেন তিনি। এ বাড়তি আয় তাকে সারাবছর সংসার চালাতে সহায়তা করে থাকে। এবছরও ঈদ-উল ফিতরকে ঘিরে তিনি তৈরি করছেন নতুন পাদুকা। কিন্তু পাদুকার তেমন বিক্রি নেই। তৈরি করা পাদুকা বিক্রি করতে না পারায় হতাশ হয়েছেন তিনি। ধনেশ্বর চন্দ্র রবিদাসের মতোই হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম,. রংপুর, গাইবান্ধা ও নীলফামারীর প্রায় ৭০০জন পাদুকা কারিগর।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার কালমাটি গ্রামের ধনেশ্বর চন্দ্র রবিদাসের দোকান রয়েছে লালমনিরহাট শহরের আলোরুপা মোড় এলাকায়। গেল দুই যুগধরে তিনি এখানেই জুতা সেলাইয়ের কাজ করছেন।
ধনেশ্বর চন্দ্র রবিদাস বলেন, প্রত্যেক উৎসবকে ঘিরে তিনি ২০০-২৫০ জোড়া নতুন পাদুকা তৈরি ও বিক্রি করেন। এবছর ঈদ-উল ফিতরকে কেন্দ্র করে ৩০০ জোড়া পাদুকা তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছেন। প্রায় ২২০ জোড়া পাদুকা তৈরি করেছেন কিন্তু এখনো ৩০ জোড়া পাদুকাও বিক্রি করতে পারেননি। গেল বছরগুলোর তুলনায় এবছর ক্রেতার সংখ্যা খুবই কম। তৈরি করা পাদুকা বিক্রি করতে পারবো কিনা শঙ্কায় রয়েছি। সবগুলো পাদুকা বিক্রি করতে না পারলে আমাকে পুঁজি হারাতে হবে। এনজিও হতে ঋণ নিয়ে আমাকে পাদুকা তৈরির কাঁচামাল কিনতে হয়েছে।
পাদুকা কারিগরদের সংগঠন বাংলাদেশ রবিদাস ফোরাম (বিআরএফ) সুত্র জানায়, উৎসবকে ঘিরে প্রত্যেক কারিগর ১৫০-৪০০ জোড়া পযর্ন্ত পাদুকা তৈরি করেন। এসব পাদুকার ক্রেতা হলেন গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ। আগের মতো জুতা সেলাইয়ের কাজ হয় না। উৎসবের সময় নতুন পাদুকা তৈরি ও বিক্রি করে আয় করতে হয় পাদুকা কারিগরদের। আগের মতো আয় না হওয়ায় অনেকেই তাদের পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেক পাদুকা কারিগর পূঁজি হারিয়ে অন্য পেশায় যুক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ভাঙ্গামোড় এলাকার মুদির দোকানদার নেহার উদ্দিন (৫৫) বলেন, উৎসবের সময় তিনি স্থানীয় পাদুকা কারিগরের কাছ থেকে পাদুকা কেনেন। স্থানীয় কারিগরদের কাছে কম দামে পাদুকা পাওয়া যায়। এছাড়া এসব পাদুকা বেশ টেকসই। ‘আমার সংসারে ৫ জোড়া পাদুকার দরকার। কিন্তু এবছর একজোড়া পাদুকাও কেনা হয়নি। হাতে টাকা না থাকার কারনে পাদুকা কিনিনি। ঈদের আগে টাকা জুটলে ২-৩ জোড়া কিনতে পারি’।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর গ্রামের পাদুকা কারিগর সুরেশ চন্দ্র রবিদাস (৫৫) বলেন, গেল বছর ঈদ-উল ফিতরের সময় ২৪০ জোড়া পাদুকা বিক্রি করেছিলেন। এবছর ২৫০ জোড়া পাদুকা বানিয়েছেন কিন্তু এখনো ২০ জোড়া পাদুকাও বিক্রি করতে পারেননি। গেল বছরগুলো মতো ক্রেতারা তার দোকানে এসে পাদুকার চাহিদাও জানাচ্ছেন না। প্রতি জোড়া পাদুকা তৈরি করতে ২০০-৩০০ টাকা খরচ হয় আর তা বিক্রি হয় ৩০০-৫০০ টাকা। তৈরি করা সবগুলো পাদুকা বিক্রি করতে না পারলে লোকসান গুণতে হবে এবছর।
কুড়িগ্রাম শহরের কলেজ রোডের পাদুকা কারিগর সুনীল চন্দ্র রবিদাস (৫২) বলেন, ‘আগের মতো জুতা সেলপাইয়ের কাজ নেই। অপেক্ষা করতে হয় উৎসবের সময় নতুন পাদুকা তৈরি ও বিক্রির জন্য। কিন্তু এবছর পাদুকার তেমন ক্রেতা নেই। নতুন পাদুকা বানিয়ে হতাশায় পড়েছি। পৈতৃক পেশা ধরে রাখতে অনেক সংগ্রাম করতে হচ্ছে। ধিরে ধিরে আমরা পৈতৃক পেশা থেকে ছিটকে পড়ছি।’
তিনি বলেন, সচ্ছল পরিবারের লোকজন স্থানীয় পাদুকা কারিহগরদের কাছে জুতা কিনেন না। তারা দোকান থেকে বেশিদামে আধুনিক জুতা কিনেন। মুলত প্রান্তিক ও নিম্ন আয়েরলোকজন তাদের ক্রেতা। এই শ্রেণির মানুষ এখন অর্থনৈতি সঙ্কটে রয়েছেন। এ কারনে এবছর তাদের তৈরি জুতা তেমন বিক্রি হচ্ছে না।
রংপুর শহরের মাহিগঞ্জ এলাকার রিক্সা চালক ছমির উদ্দিন (৪৮)বলেন, ঈদ আসলে পরিবারের লোকজনের জন্য তিনি স্থানীয় পাদুকা কারিগরদের কাছ থেকে পাদুকা কেনেন। এবছর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকায় এখনো পাদুকা কিনতে পারেননি। ঈদের আগ পযর্ন্ত নতুন পাদুকা কিনতে পারবেন কিনা তা বলতে পারছেন না। আগের চেয়ে এ বছর আর্থিক সঙ্কটে পড়েছি।
বাংলাদেশ রবিদাস ফোরামের (বিআরএফ) লালমনিরহাট জেলা ইউনিটের সভাপতি বিশ্বনাথ চন্দ্র রবিদাস বলেন, রবিদাস সম্প্রদায়ের লোকজনকে পৈতৃক পেশায় টিকিয়ে রাখতে তাদেরকে সরকারিভাবে সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা দিতে হবে। এটা করা না হলে আগামি কয়েকবছর পর এ পেশায় লোকজন দেখা যাবে না। এবছর তৈরি করা পাদুকা বিক্রি করতে না পারলে অনেকে পূঁজি হারিয়ে এ পেশা থেকে ছিটকে পড়ে যাবে।
কেকে/ এমএস