চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই ২০২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫) বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় উভয়ই কমেছে। অপরদিকে একই সময়ে গত সরকারের আমলে নেওয়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের প্রতিশ্রুতি ৬৭.৩ শতাংশ কমে ২৩৫ কোটি ৩৩ লাখ ডলারে নেমে এসেছে; যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭২০ কোটি ১১ লাখ ডলার।
গতকাল সোমবার (২৪ মার্চ) প্রকাশিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব জানা গেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ের মধ্যে উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে ৪১৩ কোটি ৪৪ লাখ ডলার ছাড় করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪৯৯ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। অর্থাৎ অর্থছাড় ১৭.৩ শতাংশ কমেছে। অপরদিকে, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ২৯.৯ শতাংশ।
ইআরডির তথ্য বলছে, উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং বিশ্বব্যাংক (আইডিএ) সবচেয়ে বেশি ঋণ প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় করেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুতি ছিল ৯৪ কোটি ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার, যেখানে অর্থছাড় হয়েছে ৯৫ কোটি ৯১ লাখ মার্কিন ডলার। একইভাবে, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রতিশ্রুতি দিলেও অর্থছাড় হয়েছে ১১৩ কোটি ৩৮ লাখ মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, জাপানের প্রতিশ্রুতি ২৫ কোটি ২১ লাখ ডলার হলেও অর্থছাড় হয়েছে ৭২ কোটি ৮৩ লাখ ডলার।
তবে কিছু বড় উন্নয়ন সহযোগী যেমন চীন, ভারত ও রাশিয়া নতুন কোনো ঋণ প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তবে তারা পূর্ববর্তী প্রকল্পের আওতায় অর্থছাড় করেছে। চীনের ক্ষেত্রে অর্থছাড় হয়েছে ২৬ কোটি ৭৮ লাখ ডলার, ভারতের ৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলার এবং রাশিয়ার ৫৩ কোটি ৬৮ লাখ ডলার।
ফেব্রুয়ারি শেষে অর্থছাড় হয়েছে ৪১৩ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে উন্নয়ন সহযোগীরা বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থছাড় করেছিল ৪৯৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। বছরের ব্যবধানে এ অর্থছাড়ের হার কমেছে ১৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।
ইআরডি জানায়, বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা আগে যেসব ঋণ দিয়েছিল, সেসব ঋণ পরিশোধের চাপ এখন প্রতিমাসেই বাড়ছে। ফেব্রুয়ারি শেষে এ অর্থবছরের আট মাসে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ২৬৩ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এ ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৩১ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। আগের বছর একই সময় বাংলাদেশ পরিশোধ করেছিল ২০৩ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ২২ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।
সংস্থাটি আরও জানায়, চলতি অর্থবছর বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। আমেরিকা ও জাপানের কাছ থেকে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ২ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার ও এডিবির কাছ থেকে ১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্য রয়েছে।
এছাড়া চলতি অর্থবছর উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য পাইপলাইনে রয়েছে ৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণ। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে এডিবির ২৭৫ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। বিশ্বব্যাংকের রয়েছে ২০৮ কোটি ডলার এবং আমেরিকা ও জাপানের যৌথভাবে রয়েছে ২০৪ কোটি ডলারের বেশি।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারের মধ্য-মেয়াদি ঋণ কৌশলে নতুন বৈদেশিক ঋণ কম নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। যদিও উন্নয়ন সহযোগীরা আগের চেয়ে বেশি ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে, সরকার শুধুমাত্র জরুরি বাজেট সহায়তা ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে ঋণ নেওয়ার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। ফলে নতুন ঋণ চুক্তির গতি কমে গেছে, যা প্রতিশ্রুতি হ্রাসের অন্যতম কারণ।
সরকারের এই কৌশলের মূল উদ্দেশ্য- বৈদেশিক ঋণের বোঝা কমানো। অনেক প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের গ্রেস পিরিয়ড (সুবিধাজনক সময়সীমা) শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন নিয়মিত কিস্তি পরিশোধের চাপ বাড়ছে। তাই নতুন ঋণ কম নিয়ে আগের নেওয়া ঋণের অর্থছাড়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ বলেন, ঋণের প্রতিশ্রুতি কমলেই যে সংকট হবে তা নয়। সরকার সঠিকভাবেই ঋণ পরিশোধ করে যাচ্ছে। যে সমস্ত দায়-দেনা আছে বাংলাদেশের এটা। এর পাশাপাশি যেহেতু রেমিট্যান্স ও রফতারি বাড়ছে, সুতরাং দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
তিনি বলেন, ভাববার বিষয় আছে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প কেন্দ্র করে অনেক রকম দুর্নীতি ও অপচয় ছিল। এগুলো বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণ পরিশোধের এই প্রবৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়তে পারে এবং সরকারের উন্নয়ন ব্যয়সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলোও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান চাপ সামাল দিতে এবং অর্থছাড় বাড়াতে সরকারকে কার্যকর কৌশল গ্রহণ করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থছাড় বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে, পাশাপাশি কম সুদে দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ সামাল দিতে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কৌশল গ্রহণ করাও জরুরি। সামগ্রিকভাবে, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে ঋণ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
কেকে/এআর