স্বাধীনতার ৫৪তম বার্ষিকীতে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয় জাতীয় স্মৃতিসৌধে। বৈষম্যমুক্ত ও বিভাজনহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন সবাই। তবে এ দিনে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে ‘একাত্তর’ ও ‘চব্বিশ’ নিয়ে নিজেদের মত জানিয়েছেন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ অনেক রাজনৈতিক দলের নেতারা।
গতকাল বুধবার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। যারা এমন কথা বলেন তারা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামকে খাটো করতে চান।’ তিনি আরো বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারকে উৎখাত করা হয়েছে। তবে এটি কোনো দ্বিতীয় স্বাধীনতা নয়।’
তবে অন্য কথা বলেছেন নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ ও ২০২৪ আলাদা কিছু নয়। একাত্তরে আমরা যা চেয়েছিলাম, চব্বিশে তা অর্জিত হয়েছে। যারা এটাকে পরস্পরবিরোধী করছে, তাদের উদ্দেশ্য অসৎ।’ তিনি আরো বলেন, ‘ক্ষমতায় বসার জন্য নির্বাচন চাপিয়ে দেওয়া হলে তা মানা হবে না। একদিকে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচন চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের ষড়যন্ত্র চলছে। সংবিধান আঁকড়ে ধরে পুরোনো বন্দোবস্তে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলে জনগণ তা মেনে নেবে না।’
বিএনপি-এনসিপি যখন কথার লড়াই তুঙ্গে তখন জামায়াতই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? এ ইস্যুতে কথা বলেছেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। গতকাল স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতে ইসলামীর আলোচনায় সভায় তিনি বলেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং সেই চেতনার ফেরি করে বেড়াচ্ছেন, তাদের বলব আপনারা কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থে, ক্ষমতার স্বার্থে দিল্লির কাছে দেশ বিক্রির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। সেদিন বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। যে কারণে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ বলেছে- এটাই আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা।’
গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী আদর্শিক কারণেই দেশ ও স্বাধীনতাকে ভালোবাসে। কিন্তু এখনো একাত্তরের মীমাংসিত বিষয় সামনে এনে জামায়াতকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়।’ জামায়াতের কার্ড নিয়ে খেললে ‘শেখ হাসিনার মতো’ নির্মমভাবে বিদায় নিতে হবে বলেও এসময় হুঁশিয়ারি দেন তিনি। গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘৫৪ বছর পর এসে যারা বক্তৃতা শেষে বলেন, একাত্তরকে ভুলে যাবেন না... তারা যখন দেশ শাসন করেছেন ১২ থেকে ১৩ জন স্বাধীনতাবিরোধীকে প্রেসিডেন্ট বানানো হয়েছে, মন্ত্রী এমপি বানানো হয়েছে।’
অন্যদিকে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবকে আড়াল করে বাংলাদেশ এগোতে পারবে না। গত ৫৪ বছরে এ দেশের মানুষ বারবার প্রতারিত হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের অসম্পূর্ণ জাতীয় কর্তব্য সম্পন্ন করতেই ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান। কারো হঠকারিতার গণঅভ্যুত্থানের অর্জন নষ্ট করা যাবে না। আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা দিবস। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার গৌরবকে আড়াল করে আমাদের সামনে এগোনো যাবে না।’ সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সাইফুল হক বলেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের গণআকাক্সক্ষা বারবার প্রতারিত ও পদদলিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বিপরীতে দেশকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানি জমানার মতো এক দেশে দুই অর্থনীতি দুই সমাজ কায়েম হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের মধ্যেও নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রশ্নে ন্যূনতম জাতীয় সমঝোতা বিনষ্ট করা যাবে না। কারো কারো হঠকারিতা ও বাড়াবাড়ির কারণে গণঅভ্যুত্থানের অর্জন নষ্ট করা যাবে না।’
এ ছাড়া এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘১৯৭১-এর যুদ্ধ ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তির লড়াই। আর ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল সেই মুক্তির অন্তরায়গুলো দূরীকরণের সংগ্রাম। সেজন্য এ গণঅভ্যুত্থানকে বাংলাদেশ ২.০ বলা হচ্ছে। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান ও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এক নয় তবে উভয়ের মধ্যে মিল রয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই হানাদারেরা নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছে, তারপরই মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে।’
মজিবুর রহমান মঞ্জু আরো বলেন, ‘২৪-এর আকাক্সক্ষা ছিল সাম্যের পক্ষে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। ঠিক যে কারণে ৭১ এ আমাদের যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করতে হয়েছে। এবি পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ৭১ এ হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল কিন্তু ২৪-এর হানাদারেরা আত্মসমর্পণ না করে হেলিকপ্টার নিয়ে পালিয়ে গেছে। তিনি বলেন, সামনের বাংলাদেশে বিচারের চ্যালেঞ্জ, সংস্কারের চ্যালেঞ্জ তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ দেশটাকে স্থিতিশীল রাখা। তিনি আরো বলেন, যে প্রত্যাশা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সে স্বপ্ন পূরণ না হওয়াতেই ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যে প্রত্যাশা তরুণরা সৃষ্টি করেছে সেটি নিভে যাওয়ার মতো নয়। সংস্কারবিহীন নির্বাচন অর্থবহ হবে না।’
এরই মধ্যে জুলাই আন্দোলনকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তোপের মুখে পড়েন ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান। গতকাল বুধবার ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ২০২৫ উদযাপন অনুষ্ঠানে এ ঘটনা ঘটে। পরে ক্ষমা চান সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান। এদিন বেলা ১১টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমে অতিথিরা আসন গ্রহণ করেন, এরপর জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরে পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ। সমাবেশ ও কুচকাওয়াজের পর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বরণ করে নেওয়া হয়। পরে অতিথিরা বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন।
একপর্যায়ে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম তার এখনো অপূর্ণতা রয়ে গেছে। যার কারণে ২০২৪ সালে জুলাই আন্দোলন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন সংবর্ধনা দিয়েছি, জুলাই আন্দোলনকারীদেরও সংবর্ধনা দেব।’ জিল্লুর রহমান বলেন, ‘যে দুই কারণে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল, একই কারণে ২০২৪-এ যুদ্ধ হয়েছে। বার বার যুদ্ধ করেছি।’
এ সময় সামনে বসে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তোপের মুখে পড়েন এ সিভিল সার্জন। তারা আসন থেকে উঠে এর প্রতিবাদ করেন। তারা বলেন, ‘আপনি বলছেন একই কারণে যুদ্ধ হয়েছে। একই কারণে না। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধের সঙ্গে ২০২৪-এর আন্দোলনে তুলনা হয় না। আপনার কথা উইড্রো করেন। আপনি নেমে যান।’ এ সময় নিজের অনাকাক্সিক্ষত ভুলের জন্য ক্ষমা চান সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান। এরপর এক বীর মুক্তিযোদ্ধা সবার কাছে ক্ষমা চান এবং সবাইকে নীরব থাকার আহ্বান জানান।
কেকে/এআর