মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের কলেজ শাখার সহকারী পরিচালক (এডি) আলমাছ উদ্দিন অনিয়ম আর ঘুষবাণিজ্যের কারণে ‘দুর্নীতির বরপুত্র’ খ্যাতি পেয়েছেন। নিয়ম ভেঙে ও ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকদের এমপিও করে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগের তদন্তও চলছে তার বিরুদ্ধে।
৫ আগস্টের পর নতুন পরিচালক অধ্যাপক মোহা. আছাদুজ্জামানকেও তার অপকর্মের সঙ্গী বানিয়েছেন আলমাছ। ফলে মিলেমিলে বাণিজ্যে নেমেছেন পরিচালক ও সহকারী পরিচালক। এমন কী পরিচালক বাসা ভাড়া না নিয়ে অফিসের গেস্টরুমকেই বাসা বানিয়ে শিক্ষা ভবনেই আস্তানা গেঁড়েছেন। তারা রাজশাহী অঞ্চলের ডিগ্রি স্তরের তৃতীয় শিক্ষকের বিশেষ এমপিওভুক্তিতে করেছেন ভয়াবহ জালিয়াতি।
তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওতে ভয়াবহ জালিয়াতি : ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রি স্তরে গভর্নিংবডি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত তৃতীয় শিক্ষকদের বিশেষ এমপিওভুক্ত করতে গত বছরের ১৫ জুলাই মাউশি রাজশাহী অঞ্চলের তৎকালীন পরিচালক (কলেজ) অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ব্যানার্জী ১০৩ জন শিক্ষকের একটি তালিকা মাউশি অধিদপ্তর, ঢাকার মহাপরিচালক বরাবর পাঠান।
এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাহিদা অনুযায়ী এমপিওভুক্ত তৃতীয় শিক্ষকদের নাম, পদবি, বিষয়, প্রতিষ্ঠানের নাম ও শিক্ষার্থীর সংখ্যাসহ মাউশি রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক আছাদুজ্জামান গত বছরের ২ ডিসেম্বর ২০৭ জনের তথ্য পাঠান। এই ২০৭ জনের মধ্যে ৪২ জনের এমপিও আগে থেকেই ছিল। যোগ্য তালিকার ১০৩ জনের মধ্য থেকেই এমপিওভুক্ত হওয়ার কথা।
তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ১০৩ জনের মধ্যে গত নভেম্বরে ৮৯ জনের এমপিও হয়েছে। আর আগে থেকেই এমপিওভুক্ত ছিল ৪২ জন। হিসাব অনুযায়ী, রাজশাহীর আঞ্চলিক পরিচালকের সবমিলিয়ে ১৩১ জন শিক্ষকের এমপিও’র নাম-তালিকা পাঠানোর কথা। কিন্তু চূড়ান্ত এমপিও তালিকায় পাঠিয়েছেন ২০৭ জনের তথ্য। সেই হিসেবে চূড়ান্ত এমপিও তালিকায় অবৈধভাবে অতিরিক্ত ৭৬ জন শিক্ষকের নাম ঢুকিয়েছেন পরিচালক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাউশির পরিচালক হিসেবে যোগদানের মাত্র ৪ মাসের মধ্যেই আছাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে নিয়ম ভেঙে টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ, বিভিন্ন বেসরকারি কলেজের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের এমপিও করে দেওয়ার বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে অন্য একটি কলেজে উপাধ্যক্ষ পদ থেকে বরখাস্ত থাকা অবস্থায় মাহবুবুর রহমান নামের এক শিক্ষককে বগুড়ার নন্দীগ্রামের মুনসুর আলী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন পরিচালক অধ্যাপক আছাদুজ্জামান।
বিধি অনুযায়ী, অধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু এই অধ্যক্ষের অনুমোদনের কোনো কাগজপত্র না থাকার পরও তিনি কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে তাকে এমপিওভুক্ত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে নাটোরের গুরুদাসপুরের রোজী মোজাম্মেল হক ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগে মামলা চলমান থাকা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন না থাকার পরও মাহাতাব উদ্দিন নামের অধ্যক্ষের এমপিওভুক্তি করেছেন তিনি। বগুড়ার মহাস্থান মহিসওয়ার ডিগ্রি কলেজে ২০১৭ সালে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে হেলাল উদ্দিন নামের একজন নিয়োগ পান।
কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, ২০১৭ সালে নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই এনটিআরসিএ কর্তৃক সুপারিশকৃত হতে হবে। কিন্তু তা না হওয়া সত্ত্বেও পরিচালক আছাদুজ্জামান তাকে এমপিওভুক্ত করেছেন। রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মহব্বতপুর খানপুর ডিগ্রি কলেজে হারুন অর রশিদ নামের একজন অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক পদে প্যাটার্ন (জনবল কাঠামো) বহির্ভুতভাবে নিয়োগ পেয়েছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর বরেন্দ্র কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে আশরাফুল হক নামের একজন প্যাটার্ন বহির্ভুতভাবে নিয়োগ পেয়েছেন। তাছাড়া এই শিক্ষকের ব্যানবেইসে তথ্য আপডেট না থাকার পরও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তাকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। এমনিভাবে নওগাঁর রাণীনগর আবাদপুকুর কলেজের ভূগোল বিভাগে প্রদর্শক পদে নাজমুল হককে, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার ড. মোজাহারুল ইসলাম মডেল কলেজে কৃষিবিভাগে আব্দুল লতিবের প্রদর্শক পদে প্যাটার্ন বহির্ভুত নিয়োগ হওয়ার পরও তাদেরকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। অথচ জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১ অনুযায়ী, প্যাটার্ন বহির্ভূত এসব পদে এমপিওভুক্তির সুযোগ নেই।
এছাড়া নাটোরের লালপুর উপজেলার কলশনগর কলেজে স্বপ্না খাতুন (মনোবিজ্ঞান) ও রাশেদুল ইসলাম (সাচিবিক বিদ্যা), নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার আজম আলী কলেজে প্রভাষক (হিসাববিজ্ঞান) পদে এবং সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক (দর্শন) আব্দুল বাকীর নিয়োগ প্যাটার্ন বহির্ভুত হওয়ার পরও এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।
এর আগে রাজশাহীর পবা উপজেলার ডাঙ্গেরহাট মহিলা কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারির প্রায় ৫১টি পদের অধিকাংশই এমপিওভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ইউজিসি অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের (নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রিধারী মামুনুর রহমান খানকে (প্রভাষক, ইংরেজি) এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। ওই কলেজে মনোবিজ্ঞানের প্রদর্শক হিসেবে ইসরাত জাহান ও আইসিটির ল্যাব সহকারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া প্যাটার্ন বহির্ভুত আব্দুল করিমের এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।
প্রত্যয়ন কমিটির আপত্তির পরও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক সুরাইয়া পারভীনের এমপিও পাকাপোক্ত করা হয়েছে। ওই কলেজে রসায়ন বিভাগের প্রভাষক হাসিবুল ইসলাম, জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক রফিকুল ইসলাম ও আরবি বিভাগের প্রভাষক দেলোয়ার হোসেনের এমপিওভুক্ত হয়েছে, অথচ এই তিনজনই ভুয়া নিবন্ধন সনদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। কৃষি শিক্ষা বিভাগের প্রভাষক মোস্তফা মাহমুদ ফিরোজ নিয়োগের সময় অনার্সের ভুয়া সনদ দাখিল করেছিলেন। এই বিষয়টি এমপিভুক্তির সময় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকার পরও তাকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া প্রদর্শক, কম্পিউটার শিক্ষা হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আবু মোয়াজ্জেম হোসেনের নিয়োগের যোগ্যতা না থাকার পরও এমপিও’র সময় বিষয়টি উত্থাপন করা হলেও তাকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।
২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী ওই বছরের ২২ অক্টোবরের পরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে কোন পদে নিয়োগ প্রদান করা হলে তা অবৈধ। অথচ রাজশাহী মেট্রোপলিটন কলেজে ২০১৭ সালে প্রভাষক পদে নিয়োগ পাওয়া আব্দুর রউফকে গত বছরের নভেম্বরে এডি আলমাছ এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা করেছেন।
তদন্তের মুখে আলমাছ : টাকার বিনিময়ে এমপিওভুক্তিসহ নানা কাজ করে দেওয়ার নামে মাউশির রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের তৎকালীন পরিচালক (কলেজ) ড. বিশ্বজিৎ ব্যানার্জি, সহকারী পরিচালক (কলেজ) আলমাছ উদ্দিন, সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (সেসিপ) প্রকল্পের গবেষণা কর্মকর্তা মানিক চন্দ্র প্রামাণিক, সহকারী পরিদর্শক আসমত আলী ও রাশেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠলে গত ৮ জানুয়ারি রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক মু. যহুর আলীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটি ইতোমধ্যেই তদন্ত কাজ সম্পন্ন করেছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক যুহুর আলী বলেন, তদন্তে অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছে। বিভিন্নপক্ষ লিখিত বক্তব্য দিয়েছে। আমরা বুঝতে পারছি, কলেজে শিক্ষক নিয়োগ থেকে এমপিও করা পর্যন্ত বিপুল টাকার লেনদেন হয়। এজন্য শিক্ষক এমপিওভুক্তির সিস্টেমটাই নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত।
সেই আলমাছ এখনো বহাল : এদিকে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তা আলমাছের অপসারণ দাবিতে স্থানীয় শিক্ষক, বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা মানববন্ধন, বিভাগীয় কমিশনারকে স্মারকলিপি ও দুদকে একাধিকবার অভিযোগ দিলেও এখনো স্বপদে বহাল থেকে দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন আলমাছ। ইতোমধ্যেই নানা কৌশলে বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক আছাদুজ্জামানকেও নিজের কব্জায় নিয়েছেন তিনি। সহকারী পরিচালক আলমাছের পরামর্শ ছাড়া কোন ফাইলেই স্বাক্ষর করেন না পরিচালক।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক ফোরামের রাজশাহী বিভাগীয় আহ্বায়ক অধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত নভেম্বরে কয়েকদিন সহকারী পরিচালক আলমাছ একইসময়ে সহকারী পরিচালক, উপ-পরিচালক ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সময় তিনি শিক্ষকদের এমপিও করার নামে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আলমাছ সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের ঘনিষ্ঠ বলে অভিযোগ করেন এই শিক্ষক নেতা।
ভুক্তভোগী অধ্যক্ষরা যা বলছেন : আলমাছের ঘুষকাণ্ডে ক্ষুব্ধ কলেজের অধ্যক্ষরা। তার মারমুখী ও বেপরোয়া আচরণে আতঙ্কিত অনেকেই। নাটোরের মহারাজা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার কলেজের এক শিক্ষকের এমপিও করে দেওয়ার নামে এডি আলমাছ ৪ লাখ টাকা নিয়েছেন। পরে আমাকে একদিন ফোন করে এক রেস্টুরেন্টে ডেকে নিয়ে ৪০ হাজার টাকা নেন। কিন্তু ওই শিক্ষকের এমপিও করে দেননি, এমনকি এখন পর্যন্ত কোন টাকাও ফেরত দেননি।’ নাটোরের সিংড়া উপজেলার রহমত ইকবাল কলেজের অধ্যক্ষ মো. মনসুর রহমান বলেন, ১৩ জানুয়ারি শিক্ষকদের নিয়ে আমি মাউশিতে যাওয়ার পর এডি আলমাছ আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন।
আলমাছ ও পরিচালকের বক্তব্য: সহকারী পরিচালক আলমাছের অনিময়-দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলতে সোমবার (২৪ মার্চ) দুপুরে এ প্রতিবেদক মাউশির রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ে ৫ম তলায় তার কক্ষে যান। কিন্তু প্রতিবেদকের উপস্থিতি টের পেয়েই তিনি নিজের চেয়ার থেকে উঠে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতগতিতে নিচে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় প্রতিবেদক আলমাছের সঙ্গে অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি ‘এখনি আসছি, অপেক্ষা করেন’ বলে পালিয়ে যান। পরেরদিন মঙ্গলবার আবারো গিয়ে দুপুর পর্যন্ত তার কার্যালয়ে অপেক্ষা করেও পাওয়া যায়নি।
পরিচালক অধ্যাপক আছাদুজ্জামান জানান, আলমাছ অফিসে আসেননি। পরে তিনি নিজেই মুঠোফোনে আলমাছকে অফিসে আসতে বলেন। কিন্তু আলমাছ জানিয়ে দেন, সাংবাদিকরা যা ইচ্ছে লিখুক। তিনি কোনো বক্তব্য দেবেন না।
এমপিওভুক্তিতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে মাউশির রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহা. আছাদুজ্জামান বলেন, ‘আমি আসার পর জানামতে কোনো অনিয়ম হয়নি। টাকা লেনদেনের কথাও জানা নেই। তবে আমার আগে টাকা লেনদেন হয়েছে বলে শুনেছি। এ বিষয়ে তদন্তও চলছে। আর অফিসের গেস্টরুমে নিয়মানুযায়ী ভাড়া পরিশোধ করেই থাকছি।
কেকে/এআর