মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫,
১৬ বৈশাখ ১৪৩২
বাংলা English

মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
শিরোনাম: রাষ্ট্রের নাম ও সংবিধানের মৌলভিত্তি পরিবর্তন করা যাবে না       অভিনেতা সিদ্দিককে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ, ভিডিও ভাইরাল      বিজিবির পা ধরে ক্ষমা চাইলো বিএসএফ      আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পুলিশের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ: প্রধান উপদেষ্টা      পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা      জামিন নামঞ্জুর করে শাহরিন তুহিনকে কারাগারে প্রেরণ      আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলেন শাহরিন তুহিন      
মুক্তমত
মোবাইল বনাম টেলিভিশন সাংবাদিকতা
আল মাহমুদ অপু
প্রকাশ: শনিবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৫, ৯:০৮ পিএম  (ভিজিটর : ১৪৬৮)
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসটা বেশ দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ। একটা সময় ছিল, যখন সংবাদ প্রচার মানেই বড় স্টুডিও, আলোর ঝলকানি, পেশাদার রিপোর্টারদের স্বর ও সাজসজ্জা। তখন সাংবাদিকতা ছিল দূর থেকে দেখা এক গৌরবময় পেশা। কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতিতে এই চিত্র বদলে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে এর রূপ, পালটেছে ধরন। আগেকার দিনে খবর বলতে বোঝাত রেডিও, পত্রিকা আর পরে টেলিভিশনের পর্দায় উপস্থাপিত নির্ধারিত সময়ের সংবাদ। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এসেছে মোবাইল সাংবাদিকতা। তবে এই নতুন ধারার সাংবাদিকতাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক বিতর্ক। তাদের সঙ্গে টেলিভিশন সাংবাদিকদের এক ধরনের ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয়েছে—যার মূলে রয়েছে গুণগত মান, পেশাদারিত্ব ও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন।

অনেক টেলিভিশন সাংবাদিক মনে করেন, মোবাইল সাংবাদিকরা মূলধারার সাংবাদিকতার আদব-কায়দা জানেন না। তারা ক্যামেরা, মঞ্চ কিংবা সংবাদের কাঠামোর প্রতি সচেতন না হয়ে শুধু ভিউ বাড়ানোর লক্ষ্যে ভিডিও তৈরি করেন। অন্যদিকে, মোবাইল সাংবাদিকরা মনে করেন—তারা সংবাদকে মানুষের কাছে খুব দ্রুত পৌঁছে দিচ্ছেন, যেটা টেলিভিশন পেরে উঠছে না। যেখানে একজন টেলিভিশন সাংবাদিক খবর পৌঁছাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নেন, সেখানে মোবাইল সাংবাদিক মুহূর্তেই পৌঁছে দেন ঘটনার বিস্তারিত।

ভিউয়ের নেশায় অনেক মোবাইল সাংবাদিক বেছে নিচ্ছেন উত্তেজক শিরোনাম, ভিত্তিহীন তথ্য, এমনকি কখনো বিভ্রান্তিকর উপস্থাপন। তারা হয়তো ঘটনাস্থলে গিয়ে লাইভ করছেন, কিন্তু সংবাদ যাচাই করছেন না। একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, কারো মধ্যে নেই পেশাগত দায়বদ্ধতা। এতে সাংবাদিকতার ভাবমূর্তি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি দর্শকদের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে অবিশ্বাস।

আজকাল কেউ পরিচয় দিলে—‘আমি সাংবাদিক’, তখনই পালটা প্রশ্ন আসে—‘কোন মিডিয়ায়? সত্যিই সাংবাদিক, না ইউটিউবার?’

এই প্রশ্নের মুখে পড়ে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন অনেক মূলধারার সাংবাদিক।

বাংলাদেশে রেডিওর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে, যখন ঢাকায় স্থাপিত হয় একটি আঞ্চলিক রেডিও কেন্দ্র। সে সময় রেডিও ছিল খবরের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। এরপর আসে পত্রিকা। ১৯৪৭ সালের আগে থেকেই ‘সংবাদ’, ‘ইত্তেফাক’, ‘আজাদ’ প্রভৃতি পত্রিকা পাঠকের হাতে হাতে ঘুরত। স্বাধীনতার পরে পত্রিকার সংখ্যা যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি গণমানুষের কাছে এর গুরুত্বও বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের (BTV) আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৪ সালে। এই ঘটনার মাধ্যমে দেশবাসী প্রথমবারের মতো টিভির পর্দায় সংবাদ দেখা শুরু করে। যদিও প্রথমদিকে এটি ছিল সীমিত পরিসরে এবং সাদাকালো, কিন্তু ধীরে ধীরে টেলিভিশন হয়ে ওঠে সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম। মানুষ পত্রিকা আর রেডিওর থেকে মুখ ফিরিয়ে টেলিভিশনের দিকে ঝুঁকতে থাকে।

টেলিভিশনের এই একচ্ছত্র আধিপত্যে পরিবর্তন আসে ২০১০ সালের পর থেকে, যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—বিশেষ করে ফেসবুক ও ইউটিউব জনপ্রিয় হতে শুরু করে। স্মার্টফোন সবার হাতে হাতে পৌঁছে যায়। যেকোনো ঘটনা, দুর্ঘটনা বা প্রতিবাদ মুহূর্তের মধ্যেই মোবাইলে ধারণ করে ফেসবুকে লাইভ করে দেওয়া শুরু করে মানুষ। এভাবেই মোবাইল সাংবাদিকতার সূচনা।

মোবাইল সাংবাদিকরা মোবাইল ফোন দিয়েই সংবাদ সংগ্রহ, চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা ও প্রচার সব কিছু একাই করেন। অর্থাৎ এক কথায় তারা ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। এটা টেলিভিশন বা পত্রিকার মতো নির্ধারিত সময়ের অপেক্ষা করে না, বরং মুহূর্তের মধ্যেই ‘লাইভ’-এর মাধ্যমে পাঠকের কাছে সংবাদ পৌঁছে যায়।

মোবাইল সাংবাদিকতার জনপ্রিয়তা বাড়ার পেছনে মূল কারণ এর সহজলভ্যতা। এমনকি মোবাইল সাংবাদিকতার জনপ্রিয়তা দেখে দেশের বহু নামকরা টেলিভিশন চ্যানেল নিজেরাই আলাদা ডিজিটাল ইউনিট গড়ে তুলেছে। ফেসবুক বা ইউটিউবে নিজেদের আলাদা নিউজ সেগমেন্ট প্রকাশ করছে। এভাবে মোবাইল সাংবাদিকতার অনুকরণে টেলিভিশন মিডিয়াও পরিবর্তিত হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে।

তবে সমস্যা শুরু হয়েছে তখনই, যখন মোবাইল সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহ বাড়লেও এর পেছনে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও জ্ঞান বাড়েনি। অনেকেই নতুন ধারার এই সাংবাদিকতা সম্পর্কে না জেনেই সাংবাদিকতা করছেন।

এই বেপরোয়া প্রবণতা থেকেই মোবাইল সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। তারা পেশাদার আচরণ জানেন না, সংবাদ পরিবেশন করেন পক্ষপাতদুষ্টভাবে, কোথাও যাচ্ছেন, লাইভে যাচ্ছেন, কিন্তু খবরের কাঠামো বোঝেন না। অনেক সময় ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ান। টেলিভিশন সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কাজের পরিবেশেও সামঞ্জস্য রাখতে পারেন না। এদের অনেকে আদতে ইউটিউবার, যারা খবরের চেয়ে ভাইরাল কনটেন্টে বেশি আগ্রহী।

ফলে একদল ‘টেলিভিশন সাংবাদিক’ মোবাইল সাংবাদিকদের ‘সাংবাদিক’ বলতেই নারাজ। তারা তাদের হেয় করেন, এড়িয়ে চলেন। কারণ, কিছু অপেশাদার মোবাইল সাংবাদিক পুরো মাধ্যমটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছেন।

বর্তমানে মোবাইল সাংবাদিকতার অন্যতম বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে তথাকথিত বিনোদন সাংবাদিকতার নামে কিছু অসাড় চর্চা নিয়ে। যারা আসলে সাংবাদিকতা করছেন না, বরং কেবল ভিউয়ের পেছনে দৌড়াচ্ছেন। একজন মানুষ যদি শুধুই সেলিব্রিটির পেছনে ক্যামেরা নিয়ে দৌড়ান, নাটকের প্রিমিয়ারে গিয়ে নামমাত্র প্রশ্ন করে লাইভ করেন, তাতে সাংবাদিকতার কী মূল্য থাকল?

এটা আসলে ‘ভিউ সাংবাদিকতা’, যেখানে সংবাদ নয়, মুখরোচকতা, গসিপ আর ক্লিকবেইটই মুখ্য হয়ে উঠেছে। এসবের কারণে সাধারণ মানুষ সাংবাদিকতা সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করে। আগে যেখানে সাংবাদিকদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকত, এখন অনেকেই সাংবাদিক দেখলে অপমানজনক মন্তব্যও করে বসেন।

এ ধরনের পরিবেশে প্রকৃত সাংবাদিকরাও সংকটে পড়েন। পরিচয় দিতে সংকোচবোধ করেন। কারণ তারা জানেন, কিছু ভিউ হাংরি ইউটিউবার বা মোবাইল সাংবাদিকের কারণে পুরো পেশাটির ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত।

মোবাইল সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে গণমাধ্যমের জন্য বড় এক আশীর্বাদ। এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবরও মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে। মোবাইল সাংবাদিকের দায়িত্ব অনেক বেশি। তাকে হতে হবে তথ্যনিষ্ঠ, দায়িত্বশীল ও পেশাদার। যে যেমন খুশি তথ্য ছড়াচ্ছে, তাকে অবশ্যই আটকাতে হবে।

তবে এও সত্যি যে, ভালো মোবাইল সাংবাদিকও আছেন। যারা সত্যিকার অর্থে সংবাদ পরিবেশন করেন, মানুষের কণ্ঠস্বর তুলে ধরেন, সাংবাদিকতার আদর্শ মেনে চলেন। তাদের কাজ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু তাদের সংখ্যাটা একেবারেই কম।

মোবাইল সাংবাদিকতা নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকে উত্তরণের উপায় একটাই—মোবাইল সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। মোবাইল সাংবাদিকতা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে ও শিখে তারপরই এই পেশায় প্রবেশ করতে হবে। যেসব অনিবন্ধিত ইউটিউব চ্যানেল আছে, যারা শুধু ভিউয়ের পেছনে ছুটে সাংবাদিকতাকে কলুষিত করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এর পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমে ‘মোবাইল সাংবাদিক’ নিয়োগের ক্ষেত্রে যেন গুণগত মানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। বাস্তব অর্থে সাংবাদিকতা জানে এমন ব্যক্তিকেই এই জায়গায় আনা দরকার। চলাফেরায়, উপস্থাপনায়, প্রশ্নোত্তরে মোবাইল সাংবাদিকদের আরো পেশাদার হতে হবে।

মোবাইল সাংবাদিকতার মাধ্যমে সাংবাদিকতা হয়েছে গণমুখী। তবে এই সম্ভাবনাময় মাধ্যমকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর গুণগত মান বজায় রাখা খুব জরুরি। মোবাইল সাংবাদিক আর টেলিভিশন সাংবাদিকদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে; সেটার সমন্বয় দরকার। কারণ দুই পক্ষই সমাজ ও মানুষের কথা বলে। তাই সম্মানের সঙ্গে, দায়িত্ববোধ নিয়ে সাংবাদিকতা করতে হবে—হোক তা ক্যামেরার সামনে কিংবা মোবাইলের ফ্রেমে।

কেকে/এএম




আরও সংবাদ   বিষয়:  মোবাইল সাংবাদিকতা   টেলিভিশন সাংবাদিকতা  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

‘আ. লীগ এখন মরা লাশ, আমাদের দায়িত্ব এ মরা লাশকে কবর দেওয়া’
মর্টার শেল বিস্ফোরণে কেঁপে উঠলো গোটা গ্রাম
‘আমাদের কথা কুরআনের আয়াত নয় যে বদলানো যাবে না’
জুয়ায় আসক্ত ছেলের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করলেন বাবা
ভিটামিনসমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা দূর করতে হবে

সর্বাধিক পঠিত

বিজিবির পা ধরে ক্ষমা চাইলো বিএসএফ
মর্টার শেল বিস্ফোরণে কেঁপে উঠলো গোটা গ্রাম
জামিন নামঞ্জুর করে শাহরিন তুহিনকে কারাগারে প্রেরণ
কোম্পানীগঞ্জে বড় ভাইয়ের হাতে ছোট ভাই খুন
জুয়ায় আসক্ত ছেলের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করলেন বাবা

মুক্তমত- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2024 Kholakagoj
🔝
close