কক্সবাজারের রামু উপজেলায় মিয়ানমার থেকে অবৈধ গরু আসা এখনো বন্ধ করতে পারেনি প্রশাসন। সীমান্তে বিজিবি থাকলেও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনায়াসে আসছে মিয়ানমারের অবৈধ গরু। আর তা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। রামু উপজেলা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা হয়ে মিয়ানমার সিমান্তে নাইক্ষ্যংছড়ি বিজিবি কয়েকটি পয়েন্টে কড়া নিরাপত্তা রাখলেও সীমান্তের বেলতলী, ছাগলখাইয়াতে সম্প্রতি প্রতিবেদক সীমান্ত এলাকা ঘুরে এসে গরু পাচারে সরাসরি জড়িত এমন কিছু গরু পাচারকারীর নাম উঠে এসেছে।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ভালোবাসা, কম্বনিয়া, তুমব্রু, বাম হাতিরছড়া, ফুলতলী, চাকঢালা, লম্বাশিয়া, ভাল্লুকখাইয়া, দৌছড়ি, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি এবং রামুর হাজিরপাড়া ও মৌলভীরকাটা দিয়েও চোরাই পথে মিয়ানমারের গরু আসছে আর তা ট্রাকযোগে এসব গরু পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়। তবে এখন তারা পাল্টেছে যাতায়াত ট্র্যাক। তারা এখন নিরাপদ স্থান হিসেবে গর্জনিয়া ইউনিয়নকে বেঁছে নিয়েছে। প্রতিনিয়ত এই ইউনিয়ন হয়ে হাজারো গরু যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
বর্তমানে সীমান্ত পার হয়ে আসছে প্রচুর বার্মিজ গরু, আর এই গরু সিমান্ত পার করতে কাজ করছে আন্তর্জাতিক মাফিয়াসহ দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। প্রতিদিন গরু পাচার করতে শ্রমিক হিসেবে যারা কাজ করছে সকলে দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত বলে জানা গেছে। আর গরু পাচার করতে ব্যবহার করছে ভারি অস্ত্র। কক্সবাজারের কচ্ছপিয়া ও গর্জনিয়া এলাকা ও সীমান্তবর্তী উপজেলার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা অরক্ষিত থাকায় মিয়ানমার থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা দিয়ে প্রতিদিন প্রবেশ করছে শত শত গরু-মহিষ। দুই উপজেলায় এই পাচার চক্র গত এক বছরে অঢেল টাকার মালিক হয়েছেন অনেকে।
এই চক্র এতটাই শক্তিশালী যে, তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও হামলা চালাতে পিছ পা হয় ন। এমনই এক ঘটনায় গত বছরের এপ্রিল মাসে ২৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবি। ইতোপূর্বে সীমান্তের ওপার থেকে প্রতিদিন গরু আসছে। ৫ আগস্ট সরকার পতন হলে রশিদ নগর এলাকা হয়ে সড়ক পথে বিভিন্ন উপায়ে অবৈধ গরু যাতায়াত করছে দেখে কিছু সুবিধাবাদী সন্ত্রাসীচক্র তাদের আটক করে ও প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করছে বলে খবর রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাশেদুল ইসলাম।
জানা গেছে, সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে আনা গরু প্রথমে গ্রামের কচ্ছপিয়া, উখিয়ার ঘোনা গর্জনিয়া ইউনিয়নের বড়বিল, ক্যাজরবিল, জোয়ারিয়ানারা ইউনিয়ন, রশিদ নগর ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গা মজুত করে পরবর্তী দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার করা হচ্ছে।
মিয়ানমার সীমান্তবর্তী দুই ইউনিয়ন কক্সবাজারের রামু উপজেলার গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়া। এই দুই ইউনিয়নের প্রধান বাজার গর্জনিয়া। সপ্তাহে দুই দিন সেখানে বসে হাট। আর এই হাট ঘিরে বেড়েছে সীমান্তে চোরাচালান। আসছে গরু, মাদক। আর সীমান্ত পেরিয়ে যাচ্ছে নিত্যপণ্য এবং জ্বালানি তেল। হাটকে ঘিরে গরু চোলাচালানের কথা স্বীকারও করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। তবে অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে অধরা।
চোরাচালান রোধে ২০০৫ সালে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাট দিয়ে মিয়ানমারের গবাদিপশুর করিডর চালু করা হয়েছিল। রাজস্ব দিয়ে এই করিডরের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা গরু-মহিষ আনতেন। তবে ২০২২ সালে দেশীয় খামারিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার করিডর বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম ও কক্সবাজারের উখিয়ার সীমান্ত দিয়ে গরু চোরাচালান শুরু হয়। চোরাই পথে আসা গরুর বৈধতা দিতে ব্যবহৃত হচ্ছে গর্জনিয়া বাজার। রামু উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সদর পার হয়ে এই বাজারে যেতে হয়। সম্প্রতি এ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক ছোট-বড় ট্রাকে গরু বোঝাই করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গরু পাচার ও ব্যবসায় জড়িত একাধিক ব্যক্তি জানান, সীমান্ত পাড়ি দেওয়া প্রতি গরু ঈদগাঁও বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে ১৯ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া চোরাকারবারিরা সশস্ত্র পাহারায় গরুর সঙ্গে ইয়াবা ও আইসের (ক্রিস্টাল মেথ) বড় চালানও নিয়ে আসছে বলে ধারনা করছে এলাকার সাধারণ মানুষ। মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো কম দামে গরুর সঙ্গে ইয়াবা ও আইসের চালান পাঠায়।
রামু উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, গর্জনিয়া ইউনিয়নে ২৬টি খামারে ৪ হাজার ৩৮৮টি এবং কচ্ছপিয়া ইউনিয়নে ৩১টি খামারে ৫ হাজার ৭৬২টি গরু পালন করা হচ্ছে। এই সব গরু এই হাটে বিক্রি করলেও ইজারার টাকা তোলা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বড় অঙ্কের টাকায় গর্জনিয়া বাজার ইজারা নিয়ে আলোচনায় এসেছেন তৌহিদুল ইসলাম। দরপত্র অনুযায়ী প্রতি মাসে এই বাজার থেকে ২ কোটি টাকার ওপরে আদায় করতে হবে। মিয়ানমার থেকে গরু না এলে এত টাকা উশুল করা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে তৌহিদুল ইসলাম জানান, ‘কেউ মিয়ানমারের গরু বাজারে এনে বেচলে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা তো চোরাই গরুর ব্যবসায় জড়িত নই।’
গরু চোরাচালানকে কেন্দ্র করে অপরাধ বাড়ার সত্যতা স্বীকার করেন রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমন কান্তি চৌধুরী জানান, কোনটি মিয়ানমারের আর কোনটি দেশি গরু তা পরখ করা কঠিন। পাচারকারীদের হাতে গরু বেচাকেনার কাগজপত্র থাকে। তারপরও চোরাচালান হওয়া পণ্য বা গরুর ধরতে তাদের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশীয় খামারের গরু দাবি করে মিয়ানমার থেকে আনা অবৈধ গরুর জাল সনদ তৈরি করে বৈধ দেখিয়ে গরু পাচার করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। প্রতিটি গরু ও মহিষ মিয়ানমার থেকে ৬০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকায় কিনে তা বিক্রি করা হয় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায়। মাঝে মধ্যে মালিকবিহীন গরু আটক হলেও চোরাকারবারিরা রয়ে যায় অধরা। এই অবস্থায় সীমান্তে গরু মহিষ ও মাদক পাচার নিয়ে সচেতন মহলের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আর মাত্র কয়েকটি ছোট পাহাড় পাড়ি দিয়ে সহজে হেটেই যাওয়া যায় সেখানে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আগে আলীকদম ও লামা পথে বামির্জ গরু মিয়ানমার থেকে পাচার হলেও বর্তমানে চোরাই গরু পাচারকারীরা তাদের পথ পাল্টে নিয়েছেন। বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ির সদর ও বাইশারী ইউনিয়নের বিভিন্ন পথে অবাধে গরু পাচার করে আসছে। তাদের দাবি, এ গরু পাচারের কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীরা এক হয়ে গেছে। আবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ব্যবসায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন। এসব গরু পাচারের সময় পাচারকারীদের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র থাকার কারণে তাদের কাছে কেউ যেতে সাহস করছে না। যার কারণে প্রশাসনও অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তবর্তী সদর ইউনিয়নের কম্বোনিয়া, জারুলিয়াছড়ি, ফুলতলী, আশারতলী, জামছড়ি, চেরারকুল, চাকঢালা, নিকুছড়ি ও বাইশারীর ঈদগড়, আলীক্ষ্যং, কাগজীখোলা ও ফাক্রিকাটামোরার নাইক্ষ্যংছড়ির সোনইছড়িসহ বিভিন্ন পয়েন্ট।
এদিকে সীমান্ত এলাকা গর্জনিয়া বাজার ইজারাদার মো. রহিম উদ্দিন অবৈধ পাচারকৃত গরু/মহিশ ও পণ্য প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে গত বছরের নভেম্বরের ৪ তারিখ রামু উপজেলা বরাবর আবেদন দাখিল করে। এর ওপর ভিত্তি করে গত ৩০ ডিসেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রামু উপজেলার বিভিন্ন দফতরকে তা অবগত করে চিঠি প্রদান করে। তাতে রামু উপজেলায় গর্জনিয়া, চাকমারকুল কাঠিরমাথা বাজারে কে নো ধরনের অবৈধ পন্থায় গরু বিক্রি ও বহন বন্ধ করতে তাগিদ দেন।
ইজারাদার রহিম উদিন জানান, অবৈধ পণ্যের কারণে বাজার ইজারার টাকা তুলতে হিমশিম খাচ্ছি। সব পণ্য চোরাই পথে চলে যাচ্ছে। স্থানীয়রা বাজারের নিজস্ব পণ্য তুলার সুযোগ পাচ্ছে না বিধায় টোল আদায় কম হচ্ছে। আশা করছি প্রশাসন এই অবৈধ গরু পাচার বন্ধ করবে।
রামু উপজেলায় অবৈধ গরু পাচার নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাশেদুল ইসলাম জানান, অবৈধ গরুসহ অবৈধ পণ্যসামগ্রী পাচার রোধে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন। অবৈধ গরু পাচার বন্ধে সংশ্লিষ্ট দফতরকে চিঠি মাধ্যমে অবগত করা হয়েঠে । আশা করছি সংশ্লিষ্ট দফতর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সম্প্রতি রামুর রশিদ নগর এলাকায় কিছু বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তা বন্ধ করা হয়েছে।
কেকে/এএস