একুশ শতকের এই তথাকথিত সভ্য যুগে দাঁড়িয়ে যখন বিশ্ব উন্নয়ন আর প্রযুক্তির চূড়ান্ত প্রশংসায় মত্ত, তখন ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা প্রতিনিয়ত রক্তে ভিজছে। ইসরায়েলের আগ্রাসন শুধুমাত্র একটি ভূখণ্ড দখলের গল্প নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক সম্পূর্ণ জাতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। দিনের পর দিন বোমা বর্ষণে মৃত্যু হচ্ছে শত শত নারী ও শিশুদের, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী ক্যাম্প। গাজার আকাশে এখন কেবল ধোঁয়া আর কান্নার গন্ধ। শুধু ধোঁয়া নয়, বোমার আঘাতে আকাশে দিকে উড়ছে মানুষের ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহাবশেষ।এমন বীভৎস দৃশ্য নিষ্ঠুর পাষাণভার মানুষের চোখ জোড়াও অশ্রুসিক্ত হচ্ছে।
এই গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ব আজো কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো একের পর এক বিবৃতি দিলেও, তা যেন শুধুই প্রথাগত এবং নিষ্প্রভ। তাদের এসব বিবৃতি কেবল ফাঁকা বুলি বটে।
বড় শক্তিগুলোর মদদে ইসরায়েল বরং আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। প্রতিনিয়ত মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন চলছে, অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখে পড়ে না ফিলিস্তিনের আর্তনাদের ধ্বনি। অনেকেই মুখে শান্তির কথা বললেও, বাস্তবে তাদের নির্লিপ্ততা বর্বরতাকে বৈধতা দিচ্ছে। এমন নির্লজ্জ বিশ্ব নেতারা। বিশেষত মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের কোনো জোরাল ভূমিকা আপাতত দৃষ্টিতে চোখে পড়ছে না।
ইতিহাসের পাতায় বহুবার ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত স্থান পেয়েছে, কিন্তু সাম্প্রতিক কালের নিষ্ঠুরতা যেন সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। এটি কোনো সামরিক সংঘর্ষ নয়, এটি একতরফা নিধনযজ্ঞ। যখন একটি জাতি অস্তিত্বের জন্য লড়ে যায়, তখন তা কেবল রাজনৈতিক ইস্যু নয়, মানবতার সংকট হয়ে ওঠে। এই সংকটে পাশে দাঁড়ানো মানে কেবল ফিলিস্তিনকে নয়, মানবতাকে বাঁচানো।
গণমাধ্যমের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পক্ষপাতদুষ্ট। আন্তর্জাতিক অনেক সংবাদমাধ্যম ‘সংঘর্ষ’ শব্দ দিয়ে আগ্রাসনের বাস্তবতা আড়াল করছে। তারা সচেতনভাবে একটি নিপীড়িত জাতির আর্তনাদকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে তথাকথিত নিরপেক্ষতার আড়ালে। এই অবস্থায় বিকল্প সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম, এবং সাধারণ মানুষের কণ্ঠই হয়ে উঠতে পারে সত্য প্রকাশের একমাত্র হাতিয়ার। তবে এর মধ্যে জীবন বাজি রেখে কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা ফিলিস্তিনের পক্ষে সত্য প্রকাশে লড়ে যাচ্ছে। আর বাকি পশ্চিমা মিডিয়াগুলো একতরফা দখলদার ইসরায়েলের পক্ষে সাফাই গাইছে।
বাংলাদেশের জনগণ বরাবরই ফিলিস্তিনের পক্ষে সোচ্চার থেকেছে। রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবাদ হয়েছে, মানববন্ধন, দোয়া মাহফিল, সহমর্মিতা জানিয়ে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে আমাদের প্রয়োজন সংগঠিত আন্তর্জাতিক অবস্থান। প্রয়োজন কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ, যাতে নির্যাতনের চক্র ভাঙা যায়, এবং ফিলিস্তিনের জনগণ ফিরে পায় তাদের ন্যায্য অধিকার ও নিরাপত্তা। আজ বিশ্বজুড়ে ‘নো ওয়ার্ক, নো স্কুল’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল। এতে একাত্মতা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশও।
এই মুহূর্তে, যখন শিশুর মুখ থেমে যাচ্ছে বোমার শব্দে, যখন মায়ের বুক খালি হচ্ছে শত্রুর গুলিতে, তখন নিরব থাকা মানে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব এখন মানবতার পক্ষে অবস্থান নেওয়া। একেকটি কণ্ঠস্বর, একেকটি প্রতিবাদ, একেকটি লেখা—সব মিলেই তৈরি হতে পারে প্রতিরোধের দেয়াল। ইতিহাস সবকিছু মনে রাখে। আজ যারা নীরব, কাল তারা বিচার এড়াতে পারবে না।
কেকে/ এএম