পেশাগত জীবনে কোনো কর্মকর্তা যদি একজন সাংবাদিককে দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করেন, তথ্য প্রদানে সহযোগী হন, প্রশ্নের জবাব দেন, কিংবা দরজাটা খোলা রাখেন তাহলে তিনি আমার কাছে একজন ভালো কর্মকর্তা। একজন সাংবাদিকের প্রয়োজন সত্য প্রকাশের পথটুকু উন্মুক্ত রাখা। পেশাগত মর্যাদার জন্য সাংবাদিকের প্রয়োজন হয় না কর্মকর্তার ব্যক্তিগত অনুগ্রহ, প্রয়োজন হয় শুধুমাত্র তার দাপ্তরিক দায়বদ্ধতা ও সঠিক তথ্য সরবরাহ।
সাংবাদিকের কাজ প্রশ্ন তোলা, অনুসন্ধান চালানো, সত্য যাচাই করে জনগণের কাছে তা তুলে ধরা। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষ নেওয়া নয়, জনস্বার্থ রক্ষা করাই তার মূল দায়িত্ব।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকের দিনে এক শ্রেণির তথাকথিত সাংবাদিক এ দায়িত্ববোধ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন। তারা সাংবাদিকতা নয়, করছেন সুবিধাবাদী দালালি। এরা কখনো রাজনৈতিক নেতার প্রশংসায় ব্যস্ত, কখনো কর্মকর্তার সঙ্গে চা খেয়ে সেলফি তোলে, আবার কখনো সহকর্মীর বিরুদ্ধে অন্যের কান ভারী করে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেন। এদের কলম চলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, এদের শব্দ চলে ঘুষ আর তোষামোদে।
দেখা যায়, অনেকেই সাংবাদিকতা শুরু করেন একমাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে, কীভাবে পরিচয়ের জোরে কিছু আদায় করা যায়। অনেকেই একটিমাত্র নিউজপোর্টালের ফেসবুক পেজ খুলে নিজেকে সাংবাদিক ঘোষণা করেন। আইডি কার্ড, প্রেস লেখা গাড়ি, আর সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা ছবি দিয়েই আজ 'সাংবাদিকতা'র মোড়ক বাঁধা হচ্ছে। অথচ কোথাও নেই সাংবাদিকতার মূল বৈশিষ্ট্য—সাহস, সততা, অনুসন্ধান।
এই ধরনের তথাকথিত সাংবাদিকরা কর্মকর্তা-কেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। তারা খবর সংগ্রহে যায় না, যায় কে কোন চেয়ারে, কে কোন গ্রুপে, কে কী বাণিজ্য করছে—তা জানতে। তারা রিপোর্ট লেখে না, বরং গন্ধ ছড়ায়। কখনো প্রশংসায় পঞ্চমুখ, আবার কখনো কুৎসায় ব্যস্ত। কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ছবি তোলা, বাসায় গিয়ে খাতির নেওয়া, জন্মদিনে কেক কাটা বা স্ত্রীর সঙ্গে ছবি তুলে 'বিশেষ সাক্ষাৎকার' লেখা—এসবই এখন তাদের ‘সংবাদ’ হয়ে উঠেছে।
আরও ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে, এরা সাংবাদিকতাকে বাণিজ্যিক অস্ত্রে পরিণত করেছে। স্থানীয় প্রশাসনের চোখে ‘চাপে রাখার’ উপায় হিসেবে নিজেরা নিজেদের তুলে ধরে, কখনো ভয় দেখায়—‘আমরা লিখে দেবো’, আবার কখনো সুযোগের অপেক্ষায় থেকে বিজ্ঞাপন কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে। কর্মকর্তার পেছনে খোঁজ নেয়, কে পছন্দের লোক, কার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, কার সন্তান কোথায় পড়ে—এসব তথ্যের ভাণ্ডার সাজিয়ে মূলত তারা ‘তদবির সাংবাদিকতা’তে ব্যস্ত।
একজন প্রকৃত সাংবাদিক এসব থেকে বহু দূরে থাকেন। তিনি তথ্য নিয়ে কাজ করেন, সত্যকে তুলে ধরেন। তার কাছে ব্যক্তি নয়, গোষ্ঠী নয়—জনগণের স্বার্থই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এমন সাংবাদিকদের হাতেই থাকে সমাজের চিত্র পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সাংবাদিকদের ভূমিকা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাদের অবদান, দুর্নীতির প্রতিবাদে তাদের কলমের ঝড়—এসবই ইতিহাসে আজও আলো ছড়ায়। কিন্তু এখন যারা সাংবাদিকতার মুখোশ পরে দালালি করছে, তারা সেই ইতিহাসের ওপর কলঙ্ক ছড়াচ্ছে।
এরা যত বেশি দলে বিভক্ত হচ্ছে, তত বেশি সাংবাদিক সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সাংবাদিকদের নিজস্ব সংগঠনগুলোও এখন অনেক ক্ষেত্রে বিভাজনের শিকার। তোষামোদকারী একটি শ্রেণি নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে গিয়ে পুরো সাংবাদিক সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো—সাংবাদিক সমাজের আত্মশুদ্ধি। আমাদের দরকার সাহসী, নীতিনিষ্ঠ, দায়িত্বশীল সাংবাদিক, যারা সত্য তুলে ধরবে, জনস্বার্থ রক্ষা করবে, এবং নিজেদের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। যারা তোষামোদ বা প্রতিপক্ষ তৈরির খেলায় মেতে উঠবে না বরং তথ্যনির্ভর সাংবাদিকতায় সমাজে আস্থা ফিরিয়ে আনবে।
সাংবাদিকতা কোনো পেশার নাম নয় কেবল, এটি একটি প্রতিজ্ঞা। এই প্রতিজ্ঞা যারা ভঙ্গ করে, তারা সাংবাদিক নয়—তারা সুযোগসন্ধানী দালাল। আর সাংবাদিকতা যদি সত্যের কণ্ঠস্বর হয়, তবে সেই কণ্ঠ যেন দালালির আওয়াজে ঢেকে না যায়। আমাদের সাংবাদিক সমাজকে সেই কণ্ঠস্বর পুনরুদ্ধার করতে হবে।
প্রশ্ন করতে হবে নিজেকে—আমি সাংবাদিক না দালাল? আমি সত্য বলবো, নাকি সুবিধার কাছে নত হবো? সাংবাদিকতা যদি বিবেকের কাজ হয়, তবে তার চর্চাও হোক বিবেকবানদের হাতেই। সময় এসেছে—দালালি নয়, নির্ভীক সাংবাদিকতা চর্চার।
কেকে/ এমএস