যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ পণ্যের শুল্ক আরোপকে ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, সেবা খাতকে বাদ দিয়ে শুধু পণ্যভিত্তিক বাণিজ্যের ওপর এ ধরনের শুল্কারোপ ট্রাম্প প্রশাসনের একপেশে কৌশল, যার পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের অভিপ্রায় রয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করতে হবে। যদিও এ শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে, তবে শঙ্কা কাটেনি উদ্যোক্তাদের। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-উত্তর বাস্তবতা ও মার্কিন শুল্ক এ দুটি বড় চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে মোকাবিলায় শিল্প খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন তারা।
গতকাল শনিবার রাজধানীর গুলশান ক্লাবে সুতা ও বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন-বিটিএমএ-এর অনুষ্ঠানে এসব অভিমত তুলে ধরেন শিল্পোদ্যোক্তা, গবেষক, ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ।
ব্যবসায়ীরা বলেন, সেবা খাতকে বাদ দিয়ে শুধু পণ্যকেন্দ্রিক বাণিজ্যে শুল্কারোপ ট্রাম্প প্রশাসনের চালাকি। এখানে ভূরাজনৈতিক আধিপত্য স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক মোকাবিলায় বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারকে এগোতে হবে। সবকিছু ছাপিয়ে দেশে শিল্পের সক্ষমতা নিশ্চিতে জোর দিতে হবে। তাদের মতে, এ সংকট মোকাবিলার পথ খুঁজতে হবে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হলো যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক চ্যালেঞ্জ। যা মোকাবিলায় শুধু বাণিজ্যকেন্দ্রিক নয়, বরং রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বনের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ বর্তমানে সর্বোচ্চ ৩৭ শতাংশ শুল্কের সম্মুখীন হচ্ছে, যেখানে ভারত ২৬ শতাংশ, পাকিস্তান ২৯ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়া ৩২ শতাংশ তুলনামূলক কম শুল্কে রফতানি করছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের তুলা কেনার বড় বাজার হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় বাণিজ্য সুবিধা পাচ্ছে না এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন আলোচকরা।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ৯০ দিনের শুল্ক মুলতবি ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, কেবল কূটনীতির মাধ্যমে নয়, বরং বাজারভিত্তিক সমাধান খুঁজে বের করাই এখন সময়ের দাবি। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দীর্ঘমেয়াদি প্রবেশাধিকার নিশ্চিতে বাংলাদেশকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে ক্রেতা ও ব্র্যান্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়া, রফানিতে যুক্তরাষ্ট্রের উপাদানের পরিমাণ বাড়ানো এবং খাতভিত্তিক প্রভাব বিশ্লেষণ করাই এখন গুরুত্বপূর্ণ।’
বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে যতই মোকাবিলার চেষ্টা করি না কেন, তার সঙ্গে মূল সমস্যাকে খুঁজে বের করে সমাধান করা অত্যন্ত জরুরি।
এ সময় বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রশাসক এবং রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে সরকার বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে দেখা শুরু করেছে। তবে ট্রাম্প ট্যারিফ শুধু বাণিজ্যকেন্দ্রিক নয় বলে মনে করছে সরকার। এজন্য ভূরাজনৈতিক ইস্যুকে মাথায় রেখে সঠিক পথে এগোনোর চেষ্টা করছে সরকার।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রশাসক হাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তুলার দাম একটি বড় বিষয়। সে হিসেবে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পোশাকের বাজারের জন্য তাদের কাছ থেকে বড় আমদানির প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এটা বাংলাদেশের মোট পোশাক রফতানির জন্য চিন্তা করলে, তা টেকসই হবে না।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রফানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি সামিম আহমেদ বলেন, আমাদের অবশ্যই সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নিজেদের এগিয়ে নিতে হবে। দক্ষতা উন্নয়ন ও ডিজাউন উন্নয়ন করতে হবে যাতে আমরা আমেরিকার বাজারে ফেস করতে পারি, চীনা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারি। ফলে আমাদের আরো প্রস্তুতি নিতে হবে কীভাবে আমরা এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারি।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, রাজনীতি অর্থনীতিরই একটা ঘনীভূত রূপ। অর্থনীতি কিংবা বাণিজ্যের যুদ্ধই রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয়। রাজনীতিতে যে যুদ্ধ চলে অনেক সময় বাণিজ্য দিয়েও একটা মাইলেজ নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এখন সে যুদ্ধ চলছে। বাণিজ্যের যে যুদ্ধ দেখা যাচ্ছে সেটা সম্ভবত পলিটিক্যাল কন্ট্রোল কিংবা মেলিটারি কিংবা আধিপত্যের যে লড়াইয়ের ধাপ।
তিনি বলেন, কত দ্রুত আমরা এফটিএ করতে পারি এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও। এফটিএ-এর ব্যাপারে অগ্রসর হওয়াটা খুবই জরুরি। দ্রুত দপক্ষেপ হিসেবে ৩ মাস সময় পাওয়া গেছে, তবে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। ইলন মাস্কও কিন্তু ট্রাম্পের শুল্কের সঙ্গে একমত নন। তার ব্যবসার জন্য বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে চীনে। কারণ চীন তার টেসলাসহ বড় ধরনের ম্যানুফ্যাচারিং সেক্টর। সুতরাং এটা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে আমরা প্রস্তুতির জায়গায় নিই।
জোনায়েদ সাকি বলেন, আমেরিকাতে ১০ শতাংশের মতো রফতানি হয়, বাকি ৯০ শতাংশ অন্যান্য জায়গায় হয়। ফলে আমাদের পলিসি এমন হওয়া উচিত হবে না যে বাকি ৯০ শতাংশ রফতানি কোনোভাবে প্রভাবিত হয়।
বিটিএমএ-এর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, আমরা সবচেয়ে বড় তুলা আমদানিকারক দেশ। তুলা আমরা আমেরিকা থেকেও আমদানি করতে পারি। সেক্ষেত্রে ১৮০টি দেশের যে আবদার আছে তার চেয়ে আমাদের আবদার একটু ভিন্ন। একটা সুযোগ আছে, আমরা যদি বোঝাতে পারি যে, আমেরিকান তুলা দিয়ে তৈরি করা পোশাকে ডিউটি ফ্রি একসেস দাও। এটা অবাস্তব নয়, অস্ট্রেলিয়া ইতোমধ্যে আমাদের সে সুযোগ দিয়েছে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরও তারা আমাদের জিরো এক্সেস দেবে। অস্ট্রেলিয়া যদি দিতে পারে, আমি মনে করি আমেরিকারও সুযোগ আছে।
তিনি বলেন, আমরা যে ৩৭ শতাংশ নিয়ে ভয় করছি, এখানে নিরাশ হওয়ার মতো কিছু নেই। আমেরিকান তুলা ২-৪ সেন্ট বেশি, কিন্তু এটা আসলে বেশি না। কারণ, এটার ফলন অনেক বেশি। কারণ ইন্ডিয়ান তুলার ১৮ শতাংশ নষ্ট হয়, সেখানে আমেরিকান তুলার মাত্র ৯ শতাংশ নষ্ট হয়। এখানে অনেক কিছুই উপকৃত হওয়ার জায়গা আছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে অন্যান্য খাত, যেটা আমাদের অর্থনীতিতে সমস্যা হতে পারে।
বিটিএমএ-এর সভাপতি বলেন, বিগত সরকার আমাদের দেশের ব্যাংকের যে অবস্থা করে দিয়ে গেছে। ব্যাংক এখন কোনো মূলধন বিনিয়োগে যেতে পারছে না। এখন সুবর্ণ সুযোগ বিদেশি কারখানাগুলো রি-লোকেশন হচ্ছে। তাদের আমন্ত্রণ জানানো উচিত, সরকারকে সাপোর্ট দেওয়া উচিত। লাইন চাইলে লাইন, পাওয়ার চাইলে পাওয়ার দেওয়া উচিত। রি-লোকেশনের মজা হলো ক্যাপিট্যাল বিনিয়োগ লাগবে না। আমরা শুধু কার্যকরী বিনিয়োগ হলেই কর্মসংস্থানও নিয়ে আসতে পারব, প্রকল্পগুলোও নিয়ে আসতে পারব। সেদিকে সরকারের সুনজর থাকা উচিত।
কেকে/এআর