সাতক্ষীরা জেলার বেশির ভাগ নলকূপের পানি আর্সেনিক, আয়রন ও লবণযুক্ত, যা পানের উপযোগী নয় বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে গেছে। কয়েক বছরে মাটিতে বেড়েছে লবণাক্ততা। উপকূলীয় এ অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকটের এ সুযোগে গড়ে উঠেছে ৫০০-এর বেশি অনুমোদনবিহীন বোতলজাত পানি উৎপাদন কারখানা। এসব কারখানায় দিনে ৮০-৯০ লাখ লিটার মানহীন পানি উৎপাদন হচ্ছে, যার পুরোটাই ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরার দুটি পৌরসভাসহ সাতটি উপজেলায়ই কমপক্ষে ২২ লাখ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে। জীবনধারণ করতে আর্সেনিক, আয়রন ও লবণযুক্ত পানি পান করছে তারা। এছাড়া উচ্চ বা মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন বোতলজাত পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এতে তাদের ব্যয়ও বাড়ছে।
সাতক্ষীরা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএসটিআই খুলনা আঞ্চলিক অফিসের পরিদর্শক আব্দুল মান্নান বলেন, জেলায় প্রায় ৫০০-৬০০ বোতলজাত পানি উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে সাত বা আটটি কারখানায় লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। অনুমোদনহীন পানি উৎপাদনকারী কারখানাগুলোয় মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়। তাছাড়া ২০টির মতো কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও রয়েছে।
সবচেয়ে বেশি পানির সংকট রয়েছে উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর, আশাশুনি, কালীগঞ্জ ও দেবহাটা। জীবনধারণের প্রয়োজনে অনিরাপদ পানি পানে বাধ্য হচ্ছে এসব অঞ্চলের মানুষ।
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ধুমঘাট গ্রামের অঞ্জলি রানী (৩৫) ও মিনতি রানী (৩২) জানান, তাদের গ্রামসহ আশপাশের গ্রামে সুপেয় পানির সংকট তীব্র। অস্বচ্ছল এসব মানুষের পক্ষে নিরাপদ পানি কিনে পান করার সামর্থ্য নেই। তাই জীবনধারণের প্রয়োজনে অধিকাংশ নারী দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহ করেন। এতে তাদের সাংসারিক কাজ ব্যাহত। শুধু ধুমঘাট নয়, পার্শ্ববর্তী জেলেখালী, মুন্সিগঞ্জ, যতিন্দ্রগর, ভৈরবনগর, আড়পাংশিয়া ও হরিনগরসহ অনেক গামে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত আর্সেনিক, আয়রন ও লবণযুক্ত পানি পান করলে মানুষের লিভার ও কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মানস কুমার মন্ডল বলেন, আর্সেনিক, আয়রন ও লবণযুক্ত পানি নিয়মিত পান করা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর মধ্যে আর্সেনিকযুক্ত পানি একাধারে পান করলে লিভার ও কিডনি আক্রান্তের পাশাপাশি মরণব্যাধি ক্যান্সারও হতে পারে। এছাড়া আয়রনযুক্ত ও লবণাক্ত পানি পান করলে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগের পাশাপাশি পেটের পীড়া দেখা দিতে পারে। সুস্থতার প্রয়োজনে পানি বিশুদ্ধ করা বা ফুটিয়ে পান করার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় পানি কমিটির তথ্য মতে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সাতক্ষীরা জেলায় কমপক্ষে ২২ লাখ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে। এখানে শতভাগ নলকূপের পানি আয়রন, আর্সেনিক ও লবণযুক্ত। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া ও তালা উপজেলার নলকূপের পানিতে রয়েছে আর্সেনিক ও আয়রন। এছাড়া শ্যামনগর, আশাশুনি, কালীগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলার নলকূপে রয়েছে লবণ, যা পানের উপযোগী নয়।
সংগঠনটির সভাপতি এবিএম শফিুকুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় পানি কমিটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে সরকারিভাবে পর্যাপ্ত পানি শোধনাগার স্থাপন করা, পুকুর খননের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং গভীর নলকূপ স্থাপন করা। এছাড়া ভূগর্ভের পানি অপচয় রোধ করার সুপারিশও করা হয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। একজন কৃষকের বোরো চাষের জন্য যে পরিমাণ পানির চাহিদা থাকে, তার তিন গুণ পানি উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভ থেকে। ফলে পানির স্তর দিন দিন নিচে চলে যাচ্ছে।
পাশাপাশি পানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভূগর্ভ থেকে প্রতিদিন যেভাবে পানি উত্তোলন করছে, তাতে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে বলে মনে করেন পরিবেশ অধিদপ্তর সাতক্ষীরা জেলার সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল।
তিনি বলেন, নিয়ম হলো বোতলজাত পানি উৎপাদন করতে হলে আগে গভীর পুকুর খনন করতে হবে। তাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে বোতলজাত পানি উৎপাদন করতে হবে। তবে সাতক্ষীরায় অবৈধ উপায়ে ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন করে বোতলজাত করা হচ্ছে। এসব পানি উৎপাদন কারখানার নেই বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বা দক্ষ কেমিস্টও নেই। এর পরও বাজারজাত করা হচ্ছে এসব পানি। তৃষ্ণার্ত মানুষও নিরুপায় হয়ে এসব মানহীন পানি কিনছে।
এ প্রসঙ্গে বোতলজাত পানি উৎপাদনকারী কারখানা মালিক সমিতির সাতক্ষীরা জেলা সভাপতি ও তাহা ড্রিংকিং ওয়াটার কোম্পানির স্বত্বাধিকারী মো. তামিম উদ্দিন জেলায় প্রায় ৬০০টি বোতলজাত পানি উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় গড়ে প্রতিদিন ২০ লিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ৬০০ বোতল পানি উৎপাদন করা হয়। এর বাইরেও এলাকার মানুষ বাড়ির কলস বা ড্রামে করেও পানি কিনে নিয়ে যায়।
প্রতিটি বোতলের দাম রাখা হয় ১৫ টাকা। জেলায় দিনে ৩ লাখ ৬০ বোতল পানি উৎপাদন হচ্ছে, যার গড় মূল্য ৫৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসে ১৬ কোটি ২০ লাখ টাকার পানি বিক্রি হয়। তাহা ড্রিংকিং ওয়াটারসহ সাতটি বোতলজাত পানি উৎপাদনকারী কারখানার বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স রয়েছে। বাকিগুলো অনুমোদনহীন।
কেকে/এএস