গণঅভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মূল্যস্ফীতির চাপসহ নানা ইস্যুতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের শিল্প খাত। যার ফলে তৈরি হয়েছে বিনিয়োগ স্থবিরতা। এরই মধ্যে শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম এক লাফে প্রায় ৩৩ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ব্যবসায়ী মহল, শিল্প উদ্যোক্তা ও অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, এ পদক্ষেপ দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্ববিরোধী ও বিনিয়োগবিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন অনেক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। তাদের মতে, একদিকে সরকার যেখানে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলছে, অন্যদিকে এমন সিদ্ধান্ত নতুন বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করবে এবং বিদ্যমান শিল্প খাতকে আরো চাপে ফেলবে। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, গ্যাসের দাম বাড়ায় বিনিয়োগ ব্যাহত হবে না, বরং টেকসই হবে। তিনি বলেন, গ্যাস রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, আর আমদানি করা এলএনজির দাম ৭০ টাকা হলেও শিল্প খাতে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৩০ টাকায়, এতে সরকারের বিপুল ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোয় ব্যবসায়ীরা গ্যাস-সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ও বিকল্প জ্বালানির দিকে ঝুঁকবেন, যা ভবিষ্যতের জন্য ভালো।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সম্প্রতি ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট ও শিল্প খাতে গ্যাসের নতুন মূল্যহার ঘোষণা করেছে। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ গ্রাহকদের জন্য গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে ৪২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা পূর্বে ছিল ৩১ টাকা। ক্যাপটিভ শ্রেণির গ্রাহকরা মূলত গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। যদি বর্তমান গ্রাহকরা তাদের অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশের বেশি গ্যাস ব্যবহার করেন, তবে তাদের গ্যাসের দামও ৪২ টাকা হতে হবে। তবে ৫০ শতাংশের কম ব্যবহার করলে গ্যাসের মূল্য থাকবে ৩১.৫০ টাকা। শিল্প খাতে নতুন গ্রাহকদের জন্য গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা পূর্বে ছিল ৩০ টাকা। পুরোনো শিল্প গ্রাহকরা যদি তাদের অনুমোদিত লোডের চেয়ে ৫০ শতাংশের বেশি গ্যাস ব্যবহার করেন, তাদেরও গ্যাসের দাম ৪০ টাকা হবে। তবে যারা ৫০ শতাংশের কম ব্যবহার করবেন, তাদের জন্য গ্যাসের মূল্য পূর্বের মতোই ৩০ টাকা থাকবে। মাঝারি শিল্প খাতে গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করা হয়েছে। যদি কোনো ভোক্তা পূর্বের অনুমোদিত লোডের চেয়ে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করেন, তাদের জন্য অতিরিক্ত ১০ টাকা হারে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধিগুলো ব্যয় বাড়িয়ে দিয়ে প্রতিযোগিতার সম্ভবতাকে আরো কিছুটা সংকুচিত করে দেয়। অভ্যন্তরীণ বাজারেও যেমন, রফতানিমুখী শিল্পের জন্যও সেই ঘটনাটি প্রযোজ্য। ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে, সব শিল্পের জন্য এই উচ্চ শুল্কে আপগ্রেডেশন করার প্রাথমিক প্রক্রিয়া হিসেবে এখনকার পদক্ষেপটি নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, আমরা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখানে সিস্টেম লসের নামে যে চুরি হয় সেটা যদি বন্ধ করা যায় এবং অযৌক্তিক কিছু কস্ট এলিমেন্ট আছে সেগুলো বাদ দেওয়া গেলে দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। তিনি বলেন, দেশে ব্যবসায়িক নীতির ধারাবাহিকতার অভাব বিনিয়োগের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা, যা নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরোনো ব্যবসায়ীরা কিছুটা চাপ নিতে পারলেও, নতুন উদ্যোক্তারা এমন চাপের সামনে হারিয়ে যেতে পারেন। গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এ পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছে, কারণ এর ফলে বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নিতে আরো বেশি সময় নেবেন, যা দেশি এবং বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগকারীর জন্য প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ঘোষিত গ্যাসের নতুন মূল্যহারকে গভীর উদ্বেগজনক ও বৈষম্যমূলক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংগঠনটির মতে, নতুন নির্দেশনার ফলে নতুন গ্রাহক, প্রতিশ্রুত গ্রাহক এবং বিদ্যমান গ্রাহকদের জন্য আলাদা আলাদা গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের টেকসই ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহের যে লক্ষ্য রয়েছে তাতে পূর্ণ সমর্থন জানালেও বিইআরসি ঘোষিত প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যহারের ফলে নতুন বিনিয়োগ ও শিল্প সম্প্রসারণ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, ‘শিল্পের প্রবৃদ্ধি এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের জন্য একটি স্বচ্ছ এবং সমন্বিত জ্বালানি মূল্য নির্ধারণ কাঠামো অপরিহার্য। আমরা বিইআরসিকে নতুন গ্যাসের মূল্য কাঠামো পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে এটি জ্বালানির চাহিদা এবং তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বিবেচনায় রেখে গৃহীত হয়। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মতো বৃহৎ লক্ষ্যগুলোকে সামনে রেখে নীতিনির্ধারণে উপযুক্ত পরিবর্তন আনার প্রয়োজন।’
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান গ্যাসের দামের বৈষম্যমূলক কাঠামোর তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘একই পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হারে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে সরকার এক ধরনের বৈষম্য তৈরি করেছে, যা ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসাম্য সৃষ্টি করছে এবং বাজারে অনৈতিক প্রতিযোগিতা উৎসাহিত করছে।’ তার মতে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসলে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করার একটি স্পষ্ট বার্তা বহন করে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় বড় বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজনের পরপরই কীভাবে এমন বিনিয়োগবিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়? এ ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করলে নতুন বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাবেন এবং শিল্প খাত আরো চাপে পড়বে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক বিবৃতে বলেন, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে দেশের অর্থনীতিতে সুবাতাস বইছে। দেশের শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যেও আশার সঞ্চার হয়েছে। বিগত সরকারের শাসনামলে শিল্পবান্ধব পরিবেশ না থাকায় নতুন শিল্প গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে অনেকেই নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এমতাবস্থায় নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সরকারের অপরিণামদর্শিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে নতুন উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হবে। তাই নতুন শিল্প বিকাশের স্বার্থে সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা উচিত।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) শিল্প খাতে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। সংগঠনটি মনে করে, এ সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া, বিনিয়োগ পরিবেশ এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাদের মতে, করোনা মহামারি ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশের অর্থনীতি এখনো স্থিতিশীল হয়নি। এমন সময়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ব্যবসা-বিনিয়োগে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে। সরকার একদিকে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলছে, অথচ অন্যদিকে এমন সিদ্ধান্ত ‘উল্টো নীতি’ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন আরো বলেছে, বিইআরসি গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য কোনো গ্রহণযোগ্য অর্থনৈতিক যুক্তি বা স্বচ্ছ প্রক্রিয়া উপস্থাপন করতে পারেনি। বরং তারা স্বীকার করেছে, এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে, যা জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থার পরিপন্থি। এ ছাড়া নতুন ও পুরোনো শিল্পের জন্য আলাদা দাম নির্ধারণ করায় বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, যা ন্যায়বিচার ও আইনের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ।
সংগঠনটি দাবি জানিয়েছে, অবিলম্বে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে। শিল্প খাতসহসংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যৌক্তিক ও সহনীয় মূল্য কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং দুর্নীতি ও অপচয় রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
কেকে/এআর