কক্সবাজারের টেকনাফের নাফ নদে জেলেদের নতুন আতঙ্কের নাম আরাকান আর্মি। গত পাঁচ মাসে মাছ ধরতে যাওয়া দেড়শ জেলেকে অপহরণ করেছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের এ বিদ্রোহী গোষ্ঠী। সশস্ত্র এ গোষ্ঠীর তৎপরতার কারণে নাফ নদে মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছেন টেকনাফের ৪০০ জেলে। এতে জেলে পরিবারগুলো সীমাহীন অর্থকষ্ট ও ভোগান্তিতে পড়েছে।
বাংলাদেশÑমিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমানার মধ্যে নাফ নদের জলসীমা পড়েছে ৮৪ কিলোমিটার। কিন্তু তিন মাস ধরে নাফ নদের জলসীমায় মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির টহল তৎপরতা বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে নাফ নদ থেকে জেলেদের ট্রলারসহ অপহরণের ঘটনাও বেড়েছে। জেলেরা এসব ঘটনার জন্য আরাকান আর্মিকে দায়ী করেছেন।
সর্বশেষ ৮ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে টেকনাফের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অদূরে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ জলসীমার মৌলভীরশীল নামক এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে চারটি ফিশিং বোটসহ ২৩ মাঝিমাল্লাকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। এ ঘটনায় আতঙ্কিত টেকনাফের অন্তত ৪০০ ট্রলারের তিন হাজার জেলে পাঁচ দিন ধরে নাফ নদে ও বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা বন্ধ রেখেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আশিকুর রহমান বলেন, গত ৮ ডিসেম্বর মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্য মংডু টাউন দখলের পর নাফ নদে ও বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে আরাকান আর্মির তৎপরতা বেড়েছে। এ সময় এ বাহিনীর সদস্যরা ১৫১ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেছেন। এর মধ্যে বিজিবির একক প্রচেষ্টায় ১৩৪ জনকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। অন্য জেলেদের দ্রুত সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আশিকুর রহমান আরো বলেন, ট্রলারসহ ২৩ বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। দ্রুত ভালো একটি সংবাদ পাওয়া যেতে পারে। এর আগেও আরাকান আর্মির সঙ্গে বিজিবি যোগাযোগ করে কয়েক দফায় দেড় শতাধিক অপহৃত বাংলাদেশি জেলেকে ফিরিয়ে এনেছে।
এদিকে ট্রলারমালিকদের দাবি, আরাকান আর্মির সদস্যরা দ্রুতগতির স্পিডবোট নিয়ে নাফ নদের বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে পড়ছেন। তারা অস্ত্রের মুখে টেকনাফের জেলেসহ মাছ ধরার ট্রলার ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। বিজিবির তৎপরতায় সম্প্রতি কিছু জেলেকে ফেরত আনা গেলেও অপহরণের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না।
সম্প্রতি বন্দিদশা থেকে ফিরে আসা টেকনাফের কয়েকজন জেলে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়া ও নিয়মিত যোগাযোগের পথ সৃষ্টি করতেই আরাকান আর্মি নাফ নদ থেকে বাংলাদেশি জেলেদের অপহরণ করছে। রাখাইনে বন্দি থাকার সময় আরাকান আর্মির সদস্যরা তাদের কাছে এমন ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, রাখাইন রাজ্য দখলের পর (গত ডিসেম্বর মাসে) আরাকান আর্মি নাফ নদে মাছ আহরণসহ নৌকা চলাচলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। এ বিষয়ে টেকনাফের জেলেদের সতর্ক করা হয়েছে, যাতে বাংলাদেশি জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে মিয়ানমারের জলসীমায় ঢুকে না পড়েন। তারপরও বাংলাদেশি জেলেদের অপহরণের ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়েছে।
গত রোববার সকাল ১০টায় টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ নৌঘাটে গিয়ে দেখা যায়, দুই শতাধিক ট্রলার ঘাটে পড়ে আছে। দুপুরে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে জালিয়াপাড়ার ঘাটেও শতাধিক নৌকা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। নৌকার জেলেরা পাশের বেড়িবাঁধে ছেঁড়া জাল সংস্কার করছেন। সেন্ট মার্টিনের শতাধিক নৌকাও সাগরে নামছে না বলে খবর পাওয়া গেছে।
ট্রলারের জেলে আবদুল আমিন, নুর আলম, মোহাম্মদ হোসেন ও রিয়াজ উদ্দিন জানান, মাছ আহরণ বন্ধ থাকায় তিন হাজারের বেশি জেলে অর্থসংকটে পড়েছেন। সংসার চালাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ৮ এপ্রিল সেন্ট মার্টিন উপকূল থেকে চারটি ট্রলারসহ ২৩ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। এর মধ্যে শাহপরীর দ্বীপের আবদুল শুক্কুরের মালিকানাধীন একটি ট্রলারে জেলে ছিলেন ৫ জন, মোহাম্মদ শাওনের একটি ট্রলারে ৬ ও আবদুল হাকিমের দুটি ট্রলারে ১২ জন। ট্রলারমালিক আবদুল শুক্কুর ও আবদুল হাকিম বলেন, জেলেদের সন্ধান মিলছে না। আরাকান আর্মি স্পিডবোটে এসে জেলেদের ধরে নিয়ে যায়। সাগরে নেমে ২৩ জেলেকে অস্ত্রের মুখে রাখাইন রাজ্যের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় ধরে নিয়ে গেছে। সেখানে কী অবস্থায় আছে খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
কেকে/এআর