বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একদল নীতি চর্চা করেছে ভারত। অর্থাৎ বাংলাদেশের শুধু একটি দলের সঙ্গেই তাদের সম্পর্ক ছিল, আর সেটা আওয়ামী লীগ। কিন্তু দেশের অপর বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নিয়ে ভারতের সবসময়ই অস্বস্তি ছিল। তবে বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে সাজাতে হবে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগকে নিয়ে তাদের একচোখা নীতির পরিবর্তন করতে হবে।
সেই ইঙ্গিতও দেখা গেছে অবশ্য। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বাংলাদেশের অন্তবীর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন। সেখানে তিনি বলেন, ভারতের সম্পর্ক বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে, কোনো একক দল বা ব্যক্তির সঙ্গে নয়।
তবে বিএনপির সঙ্গে ভারতের শীতল সম্পর্ক নিয়ে দেশটির বিশ্লেষকদের যুক্তি, অতীতে বিএনপি শাসনামলের অভিজ্ঞতা ভারতের জন্য তেমন ভালো ছিল না বলেই দু’পক্ষের মধ্যে আস্থা বা ভরসার সম্পর্ক সেভাবে গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে বিএনপির বক্তব্য, তারা বাংলাদেশে ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতি’র বিরোধী এবং যে কোনো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সমান মর্যাদার ভিত্তিতে দেখতে চায়। তাই বলে তাদের ভারত-বিরোধী বলে চিহ্নিত করার কোনো যুক্তি নেই।
২০১৪ সালে যখন নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি প্রথমবারের মতো ভারতের ক্ষমতায় আসে, বিএনপির পক্ষ থেকে সম্পর্কের এই শীতলতা দূর করার একটা সক্রিয় উদ্যোগ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। বিএনপির ধারণা ছিল, যে কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রায় ঐতিহাসিক একটা সুসম্পর্ক রয়েছে, তাদের শাসনের অবসানের পর দক্ষিণপন্থি বিজেপির সঙ্গে বিএনপির মধ্যে একটা নতুন সমীকরণের সূচনা হতে পারে। প্রাথমিকভাবে তাতে দিল্লির দিক থেকে কিছুটা ইতিবাচক সাড়া মিললেও শেষ পর্যন্ত সেই সম্পর্কও কিন্তু সেভাবে দানা বাঁধেনি। উল্টোদিকে প্রায় রেকর্ড সময়ের মধ্যে জমাট বেঁধেছে নরেন্দ্র মোদি আর শেখ হাসিনার পার্সোনাল কেমিস্ট্রি বা ব্যক্তিগত রসায়ন, মজবুত হয়েছে দুই সরকারের সম্পর্ক। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের পরপর তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে ভারতের ‘চোখ বন্ধ করে’ আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থনের ঘটনাও দিল্লির প্রতি বিএনপির অবিশ্বাসকে বদ্ধমূল করেছিল।
কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে যে নাটকীয় পটপরিবর্তন ঘটে গেছে, সেই ঘটনাপ্রবাহ বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে একটা বাঁকবদলের অবকাশ তৈরি করেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। দিল্লিতে রাজনীতি, নিরাপত্তা বা কূটনীতির পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ভারতের বিশেষ কয়েকটি দাবি বা ‘প্রয়োজনে’ যদি বিএনপি ইতিবাচক সাড়া দেয়, তাহলে ভারতের দিক থেকেও বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত বাড়াতে কোনো অসুবিধা থাকার কারণ নেই।
এদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে বিজেপি নেতারা বলছেন, বাংলাদেশে বিএনপি বা অন্য যে কোনো দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্থাপনের মূল ভিত্তিটাই হবে ক্ষমতায় এলে তারা সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারছেন কি না, সেটা।
অন্যদিকে ভারতীয়দের নীতিনির্ধারকদের বিশ্বাস, বিএনপির ডিএনএতেই আছে ভারত বিরোধিতার রাজনীতি, আর দলটার রাজনৈতিক উত্থানের পেছনেও এর একটা বড় ভূমিকা আছে। বিএনপি অবশ্য বলে থাকে, বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা কখনোই তাদের নীতি ছিল না, তারা চায় ভারতের সঙ্গে একটি মর্যাদা ও সম্মানের সম্পর্ক। এই অবস্থানকে যে নামেই ডাকা হোক, বিএনপি তাদের সেই পুরোনো রাজনীতি থেকে এখন কতটা সরবে তা নিয়ে কিন্তু সন্দিহান দিল্লিতে অনেক পর্যবেক্ষক।
এদিকে ভারতের দিক থেকে সম্পূর্ণ অন্য একটি কারণেও বিএনপির সঙ্গে দিল্লির এখন একটা সম্পর্ক স্থাপনের ভালো সুযোগ তৈরি হয়েছে। কারণ দীর্ঘদিনের জোট সঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বাড়ছে। ভারতের কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকরা এখনো একান্ত আলোচনায় পরিষ্কারই বলছেন আগামী দিনে বিএনপির সঙ্গে তাদের যে কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান শর্ত হতে হবে জামায়াতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সঙ্গ তাদের ত্যাগ করতেই হবে।
বিএনপি ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্ভবত সবচেয়ে বড় অস্বস্তির জায়গাটা হলো ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চার দলীয় জোট সরকারের শাসনামলের বিভিন্ন ঘটনা। ভারত বিশ্বাস করে সে সময় উলফাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশে ঢালাও আশ্রয় পেয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে উলফার জন্য ট্রাকে করে অস্ত্র পাচারের ঘটনাও এ সময়কারই।
ভারতের পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন সেভেন সিস্টার্সের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যদি ‘প্রশ্রয়’ না পায় কিংবা চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধা বহাল থাকে, বিএনপির সঙ্গে ‘ডিল’ করতেও ভারতের কোনো সমস্যা নেই।
তবে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই হোক বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, ভারত এখন স্থির করেছে নির্বাচনের আগে অন্তত বাংলাদেশের বিশেষ কোনো দলের প্রতিই প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানানো হবে না, বা থাকলেও অন্তত সেটা প্রকাশ করা হবে না। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, তারা চায় বাংলাদেশে একটি ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক) ও পার্টিসিপেটরি (অংশগ্রহণমূলক) নির্বাচন- যাতে সব দল ও মতের মানুষ ভোটে লড়ার সুযোগ পায়।
এই মুহূর্তে ভারতের কৌশলটাই হলো- বাংলাদেশে যত তাড়াতাড়ি একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনে চাপ দেওয়া এবং তাতে যারাই জিতে ক্ষমতায় আসুক, তাদের সঙ্গে একটা ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ তৈরির পথ প্রস্তুত করে রাখা।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
কেকে/এআর