চিকিৎসার জন্য চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে লন্ডনে অবস্থান করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। আর এক-এগারোর পটপরিবর্তনের সময় থেকে সেখানে রয়েছেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বেলজিয়াম সফরে যান জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। সেখান থেকে লন্ডনে যান তারা। গত রোববার সেখানে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জামায়াতের এ দুই শীর্ষ নেতা।
এ বৈঠকে গলেছে অনেক বরফ। প্রশমিত হয়েছে জমে থাকা নানা ক্ষোভ। আবার একসঙ্গে পথ চলতে সম্মত হয়েছে দল দুটির শীর্ষ নেতারা। এমন আভাসই দিচ্ছেন বৈঠক সংশ্লিষ্টরা। এর মাধ্যমে জোটভুক্ত না হলেও পরস্পর সমঝোতার ভিত্তিতে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে তারা। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন- বিএনপির গুডবুক থেকে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নাম সরে গেছে। এখন সেখানে বিচরণ করছে জামায়াতে ইসলামী। ফলে বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে- এনসিপি আউট-জামায়াত ইন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াত আমিরের বুধবারের বক্তব্যই প্রমাণ করে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন- এতদিন ধরে জামায়াত দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের পক্ষে ছিল না। তারা বিএনপির নির্বাচনি রোডম্যাপের তাগিদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলে আসছিল- যথাযথ সংস্কার শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু লন্ডন বৈঠকের পর দেশে এসে জামায়াত আমির বুধবার মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে সরকারকে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়েছেন। এটাই প্রমাণ করে- জামায়াত এখন বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলা শুরু করেছে। আর এনসিপি বিএনপির বিরোধিতা করে কথা বলছে।
গতকাল বুধবার মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফকালে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘সরকার ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে কথা বলছে আমরা এত দেরিতে নির্বাচন চাই না। আগামী রমজানের আগে (ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রমজান শুরু) আমরা নির্বাচন চাই। মার্কিন প্রতিনিধিদলকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।’
গুলশানে মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশনের বাসায় এ বৈঠক হয়। এ সময় জামায়াতের আমিরের সঙ্গে ছিলেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শফিকুর রহমান বলেন, ‘সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এ বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তার (প্রধান উপদেষ্টা) কমিটমেন্টে তিনি ঠিক আছেন কি না, আমরা সেটা দেখতে চাই।’ জামায়াতের আমির আরো বলেন, ‘আমাদের ভিউ হচ্ছে, এটা (নির্বাচন) রমজানের আগেই শেষ করতে হবে। জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে বর্ষা, বিভিন্ন ধরনের ঝড়ঝাপটা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে। তখন আবার ইলেকশনটা (নির্বাচন) অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। সে জন্য আমরা চাইছি, ওই আশঙ্কার আগেই যেন নির্বাচন হয়ে যায়।’
অপরদিকে মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করে বলেছেন, ‘এ ধরনের প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব নয়।’ বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বলেছি যে আমরা এখানে ন্যূনতম সংস্কার নয় বরং রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের জন্য আমরা কাজ করছি। এই পরিবর্তনগুলো ছাড়া নির্বাচন হলে, তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সেই নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি অংশগ্রহণ করবে কি না, সেটাও বিবেচনাধীন থাকবে।’
গুলশানে মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশনের বাসায় এ বৈঠক হয়। বৈঠকে নাহিদ ইসলামের সঙ্গে দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা অংশ নেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এনসিপির নেতারা। মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নাহিদ বলেন, ‘সংস্কার বিষয়ে আমরা যেই প্রস্তাবনাগুলো সংস্কার কমিশনে দিয়েছি, সেগুলোর কথা বলেছি। আমরা বলেছি আমাদের তিনটি দাবির কথা-সংস্কার, বিচার ও গণপরিষদ নির্বাচন।’
কোনো ধরনের ন্যূনতম সংস্কার নয় বরং মৌলিক সংস্কার নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কাজ করছে জানিয়ে নাহিদ বলেন, ‘আমরা এখানে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, গুণগত পরিবর্তনের জন্য কাজ করছি। কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচনের দিকে গেলে সে নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হবে না এবং সে নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি অংশগ্রহণ করবে কি না, সেটাও বিবেচনাধীন থাকবে।’
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান সময়ে যে মাঠ প্রশাসন রয়েছে, সেই মাঠ প্রশাসন আমাদের কাছে মনে হয়েছে নিরপেক্ষ আচরণ করছে না। বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চলছে, সেই জায়গায় প্রশাসনকে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করতে দেখছি, সেই জায়গাগুলো আমরা বলেছি।’
প্রশাসন নিরপেক্ষ না হয়ে কার পক্ষ নিচ্ছে-এমন প্রশ্নের জবাবে নাহিদ বলেন, ‘আমরা লক্ষ করছি প্রশাসন আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ অবলম্বন করছে। অনেক জায়গায় এবং মাঠপর্যায়ে যে ধরনের চাঁদাবাজি চলছে, সেই জায়গায়ও মাঠ প্রশাসন আসলে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে। আমরা বলেছি, যদি এ ধরনের একটা প্রশাসন থাকে, তাহলে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন, আমলাতন্ত্র এবং পুলিশ আমাদের ঠিক করতে হবে।’
এদিকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের এই বৈঠক এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হলো যখন বাংলাদেশে দুই দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে পরস্পর বিরোধী অবস্থান ও পাল্টাপাল্টি কথার লড়াই চলছিল। জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে আগামীতে দুই দলের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে।’
তবে তিনি সম্পর্ক ‘দৃঢ়’ করার প্রত্যাশা জানালেও, একসময়ের জোটসঙ্গী দুই দলের সম্পর্কে বেশ কিছুদিন ধরে বিরোধিতা, সমালোচনা ও বিতর্কই বেশি দৃশ্যমান হয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে সংস্কার, নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধের মত ইস্যুগুলোতে স্পষ্ট হয়েছে পরস্পরের মতভেদ। এমন প্রেক্ষাপটে দুই দলের শীর্ষ নেতাদের সাক্ষাৎ রাজনীতির অঙ্গনে কৌতূহল তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘এটা তাদের মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার একটা চেষ্টা হতে পারে। তেমন চেষ্টা হয়ে থাকলে কয়েকদিন পরে এর প্রভাব বোঝা যাবে। দেখতে হবে কয়েকদিন পরে তারা পরস্পরের প্রতি বিষোদগার করছে কি না, যদি বিষোদগার কমে আসে তাহলে বুঝতে হবে এই সাক্ষাৎ ও বৈঠক একটা ভূমিকা রেখেছে।’
কেকে/এআর