সীমান্তে কমছেই না হত্যা-হামলার ঘটনা। বাংলাদেশি নাগরিকদের পিটিয়ে ও গুলি করে মারছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) সদস্যরা। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে প্রবেশ করে মানুষের ওপর হামলা করছে। কখনো ধরে নিয়ে চালাচ্ছে অমানবিক নির্যাতন। প্রতিনিয়ত উদ্বেগজনকহারে ঘটছে এসব ঘটনা। সীমান্তে বাড়ছে উত্তেজনা। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর বার্তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি)।
তবে সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় আনতে ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে পতাকা বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সীমান্ত হত্যাকাণ্ড থামেনি, বন্ধ হয়নি মৃত্যু।
গতকাল বুধবার লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হাসিবুল আলম (২৪) নামের এক যুবককে ধরে নিয়ে গিয়ে চোখে গুলি করেছে। আহত হাসিবুল আলম ওই এলাকার জাহিদুল ইসলামের ছেলে। এ ঘটনায় সীমান্ত উত্তেজনার কারণে বিজিবি ও পুলিশ অবস্থান করছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হাসিবুলসহ কয়েকজন ওই সীমান্তে বাংলাদেশি জমিতে ঘাস কাটতে যায়। এ সময় ভারতের শীতলকুচি এলাকার নগর সিঙ্গিমারী ক্যাম্পের বিএসএফের টহল দল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ওই টহল দল বাংলাদেশে প্রবেশ করে পেছন থেকে হাসিবুলকে আটক করে ভারতের অভ্যন্তরে নিয়ে যায়। এ সময় তাকে বিএসএফের গাড়িতে তোলার সময় চোখে গুলি করে। পরে তাকে কুচবিহারের একটি হাসপাতালে ভর্তি করায় বিএসএফ। সীমান্তের একটি সূত্র বিষয়টি জানিয়েছে।
বিজিবি সূত্র থেকে জানায়, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে পতাকা বৈঠকের প্রস্তুতি চলছে। হাতীবান্ধা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহামুদুন-নবী বলেন, ‘সীমান্তবর্তী লোকজন আমাকে জানিয়েছেন হাসিবুল নামে এক যুবককে ভারতীয় বিএসএফ সীমান্ত থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করেছে।
এদিকে গত মঙ্গলবার গভীর রাতে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে প্রবেশ করে বিএসএফ সদস্যরা এক দল জেলের ওপর হামলা চালিয়েছে। সীমান্তবর্তী কালিন্দি নদীর বয়ারসিং সংলগ্ন উলোখালীর চর এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। এসময় জেলেদের মারধর করে তাদের দুটি নৌকা বিএসএফ সদস্যরা ছিনিয়ে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী জেলেরা।
বিএসএফের হামলার শিকার জেলেরা হলেন- শ্যামনগর উপজেলার টেংরাখালী গ্রামের মোহাম্মদের ছেলে রমজান, শাহাজান, ফরেজ গাজীর ছেলে শাহাদাৎ, শাহাজান, আতাউর, সৈয়দ গাজীর ছেলে আব্দুল, মানিকপুর গ্রামের কেরামত ও কৈখালীর নুর মোহাম্মদ।
হামলার শিকার শাহাদাৎ হোসেন জানান, পশ্চিম সুন্দরবনের কৈখালী স্টেশন থেকে পাস (অনুমতিপত্র) নিয়ে চারদিন আগে তারা সুন্দরবনে যান। তিনটি নৌকার ১২ জন জেলে দু’দিন ধরে বাংলাদেশের সীমানাভুক্ত উলোখালীর চরে পাটা জাল পেতে মাছ ধরছিলেন। একপর্যায়ে মঙ্গলবার দুটি স্পিডবোট নিয়ে বিএসএফ সদস্যরা আকস্মিকভাবে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের মারধর শুরু করেন। বর্ডার এলাকায় মাছ ধরতে যাওয়ার কারণে হামলা করা হয়েছে। স্থানীয় রমজাননগর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ লাল্টু ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, বিএসএফের মারধরের শিকার আট জেলের মধ্যে ছয়জন তার এলাকার।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মশিউর রহমান জানান, এখনো কেউ বিষয়টি তাদের অবহিত করেনি। খোঁজখবর নিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিজিবি কৈখালী ক্যাম্পের সুবেদার আবু বক্কার জানান, স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি বিষয়টি অবহিত করেছেন। ঘটনাটি বয়ারসিং এলাকার হওয়ায় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ জানাতে সেখানকার বিজিবি (রিভারাইন) ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
এছাড়াও সম্প্রতি দেশে সীমান্ত এলাকায় বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার পলিয়ানপুর সীমান্তে ওয়াসিম নামের এক বাংলাদেশি যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছে ভারতীয় সিমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। গত ৮ এপ্রিল ওয়াসিমসহ কয়েকজন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যায়। ভারত থেকে ফেরার সময় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তাদের ধাওয়া করলে অন্যরা পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও বিএসএফের হাতে ধরা পড়ে ওয়াসিম। তাকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে।
এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর সীমান্তে ভারতের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফের সদস্যদের পিটুনিতে এক যুবক নিহত হয়েছেন বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে আহত অবস্থায় ওই যুবককে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত মুরাদুল ইসলাম ওরফে মুন্না (৪০) বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ইউনিয়নের সেজামুড়া সীমান্তের মৃত ফজলুর রহমানের ছেলে। গত ১ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে আল-আমীন (৩২) নামের এক যুবক নিহত হয়। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, গতকাল সন্ধ্যায় পুটিয়া সীমান্তে কয়েকজন বাংলাদেশিকে লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছোড়ে বিএসএফ। এতে আহত হন আল-আমীন। রাত নয়টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। স্থানীয় একাধিক বাসিন্দার দাবি, সীমান্তের এ জায়গায় গত বছরের ২৫ নভেম্বর দুই যুবক গুলিতে আহত এবং গত ২২ এপ্রিল মেহেদী হাসান নামের একজন নিহত হন।
এর আগে গত ১০ এপ্রিল সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের মোকামছড়া সীমান্তের বিপরীতে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের নথরাই পুঞ্জি এলাকায় সুপারি চুরি করতে গিয়ে খাসিয়ার গুলিতে কুটি মিয়া (৫০) নামে এক বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। সম্প্রতি পঞ্চগড় সদর উপজেলার ভিতরগড় সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে আল-আমিন (৩৬) নামে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হয়েছেন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিএসএফের হাতে মোট ৩০ জন বাংলাদেশি সীমান্তে নিহত হন। নিহতদের মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ২৫ জনকে। একই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ৩১ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ। এর মধ্যে ২৮ জনই গুলিতে নিহত হয়েছেন। আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে ও নির্যাতনে অন্তত ৬০৭ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। আর অধিকার নামের মানবাধিকার সংস্থাটির মতে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিএসএফ সদস্যদের হাতে অন্তত ৫৮২ বাংলাদেশি নিহত ও ৭৬১ জন আহত হয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্তে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বাস্তবতা ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ফেলানীসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশিদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বিএসএফের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ এবং সীমান্তে নতুন পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে। শুধু সরকার একা নয়, রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনার মাধ্যমে ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারতকে এটা বোঝাতে হবে শুধু আমাদেরই তাদের দরকার না, তাদেরও আমাদের দরকার।’
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় আনতে ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা। সীমান্তে মারণাস্ত্র (লেথাল উইপন) বন্ধ করারও প্রতিশ্রুতি আছে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। সীমান্তে যত বাংলাদেশি নাগরিক বিএসএফের হাতে নিহত হয় তার ৯০ ভাগই গুলিতে নিহত হয়।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) মো. শহীদুল হক বলেন, ‘‘আসলে সীমান্তে ভারত যা করছে তা নতুন নয়। গত ১৫ বছরে বিএসএফ সীমান্ত হত্যা চালিয়েছে। কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। তখন সরকার কিছু বলেনি। বাংলাদেশের সীমান্তে এখন একটা অস্থির পরিস্থিতি দেখাতে চায় ভারত। এটা নিয়ে তার রাজনীতি আছে।’’
সীমান্ত হত্যা বন্ধে বাংলাদেশকে আসলে কিছু কৌশল অবলম্বন করা উচিত বলে মনে করেন বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) মিয়া মশিউজ্জামান। তার কথা, ‘‘জবাবটা ঠিক মতো দিতে হয়। তারা যেরকম আচরণ করবে আমাদের ঠিক একই আচরণ করে জবাব দিতে হবে। এটা তো আর প্রকাশ্যে বলা যায় না। এটা কানে কানে জানিয়ে দিতে হয়।’’
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ও বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে জোরালো দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ। গত ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির লোদি রোডের সিজিও কমপ্লেক্সে বিএসএফের সদর দফতরে দুই দেশের মহাপরিচালক পর্যায়ে এ বৈঠকে এ দাবি জানানো হয়। বিজিবি বলেছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের স্বার্থেই সীমান্ত হত্যা পুরোপুরি বন্ধ হওয়া দরকার। গুলি করে কাউকে মেরে ফেলা মানবাধিকার পরিপন্থি।
সীমান্তে কেউ অপরাধ করলে তাকে ধরা হোক। প্রচলিত আইনে শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু মেরে ফেলা অমানবিক। বৈঠকে সাম্প্রতিক সময়ে কাঁটাতারের বেড়াসহ সীমান্ত নিরাপত্তার নানা দিক তুলে ধরা হয় বিজিবির পক্ষ থেকে। এর মধ্যে সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়টি জোরালোভাবে বিজিবির পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিএসএফ সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় আনতে সব সময় চেষ্টা করে। কিন্তু কখনো কখনো সংগঠিত অপরাধচক্র এতটাই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে যে, গুলি চালানো ছাড়া উপায় থাকে না। এ প্রবণতা ও অপরাধ বন্ধে সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা রূপায়ণের ওপর জোর দেওয়ার কথা বৈঠকে তুলে ধরে বিএসএফ।
গত ১ মার্চ কক্সবাজারে ৬৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ‘ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) সীমান্ত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রাখলে আরো ‘কঠোর অবস্থানে’ যাবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটুক আর যাই ঘটুক, হত্যা কোনো চূড়ান্ত সমাধান হতে পারে না। আর যদি একটি হত্যার ঘটনাও ঘটে, তাহলে আমরা আরো কঠোর অবস্থানে যাব।’
কেকে/এআর