বাংলাদেশের স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বাতিল করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট জারি করা প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে নতুন এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ আদেশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা হয়।
বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা, বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে মূলত ভারত থেকে সুতা আমদানি হতো। এসব বন্দর দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১২ লাখ ১৫ হাজার টন সুতা আমদানি করা হয়। গত বছর এ আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশে চাহিদা অনুযায়ী প্রায় ৯৫ শতাংশ সুতা ভারত থেকে আমদানি করা হয়। আর এ সুতা তৈরি হয় কার্পাস তুলা দিয়ে। এ তুলার বেশিরভাগই আসে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। এদিকে ভারতীয় হিসেবে প্রতি বছর দেশটি বাংলাদেশে ২ বিলিয়ন রুপির সুতা রফতানি করে। তবে বাংলাদেশের নতুন সিদ্ধান্তে বিপুল বাজার হারিয়েছে তারা। ক্ষতির সম্মুখীন হবে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের তুলা চাষিরা।
ভারতীয় সুতা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশের এ সিদ্ধান্তে ক্ষতির মুখে পড়বেন তারা। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসায়ীরা বাজার হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। তারা বিষয়টিকে বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নরেন্দ্র মোদির হার হিসেবে দেখছেন।
এ বিষয়ে ভারতের একটি বেসরকারি চ্যানেলে দেশটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ ভারতীয় অর্থনীতির ওপর একটা ধাক্কা দিতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আমাদের সবচেয়ে বড় মার্কেট। বাংলাদেশের পোশাক খাত বিশ্বের অন্যতম। দেশটির ৭০ শতাংশ বৈদেশিক আয় হয় রেডিমেট গার্মেন্টস থেকে। তাই সুতা তাদের প্রয়োজন হয়। বেশ বড় অঙ্কের টাকার আমরা এক্সপোর্ট করি। কিন্তু এটা (এনবিআরের সিদ্ধান্ত) আমাদের কটন ইন্ডাস্টির জন্য বেশ ধাক্কা। তিনি আরো বলেন, আমরা ভিয়েতনাম ও চায়নায় (সুতা) বিক্রি করি। এখন ওসব জায়গায় আমাদের মার্কেট বাড়াতে হবে। না হলে আমরা মন্দার মধ্যে পড়ব।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীরা বছলেন, বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সুতা কেনে। যার বাজার প্রায় দুই বিলিয়ন রুপির। ওরা আমাদের দেশ থেকে সুতা কিনবে না। এটা নিসন্দেহে আমাদের জন্য বড় ধাক্কা।
ভারতীয় পোশাক রফতানিকারক গৌরাঙ্গ চন্দ্র মজুমদার জানান, শিল্পের কাঁচামাল রফতানির জন্য ভারতের একটি বড় বাজার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে সুতা আমদানি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের চাষিদের। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতির ফলে কাঁচামালের একটা বড় বাজার হারাবে ভারত। আর এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হাজারো মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে।
জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে বস্ত্র খাতের অন্যতম কাঁচামাল সুতা আমদানি বন্ধের দাবি জানায় বস্ত্র শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। এরপর গত মার্চ মাসে এক চিঠিতে পোশাকশিল্পে দেশে তৈরি সুতার ব্যবহার বাড়াতে স্থলবন্দর দিয়ে পোশাকশিল্পের সুতা আমদানি বন্ধ করার জন্য এনবিআরকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। তখন ট্যারিফ কমিশন থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে পাঠানো চিঠিতে দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পের স্বার্থ সংরক্ষণে সব সীমান্তসংলগ্ন সড়ক ও রেলপথ এবং স্থলবন্দর ও কাস্টম হাউসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে সুতা কাউন্ট নির্ণয়ে যথাযথ অবকাঠামো প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত আগের মতো সমুদ্রবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির সুপারিশ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেন। তবে স্থলপথ ছাড়া সমুদ্রপথে বা অন্য কোনো পথে সুতা আমদানি করা যাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভারতের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে উৎপাদিত সুতা কলকাতায় গুদামজাত করা হয়। এরপর সেখান থেকে সুতা বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এসব সুতা তুলনামূলক কম দামে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এ কারণে দেশি সুতার পরিবর্তে স্থলবন্দর দিয়ে আসা সুতা বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কারণে দেশের বস্ত্রশিল্প কারখানাগুলো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে বলে দাবি করেছিল বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ)।
এদিকে চীন, তুরস্ক, উজবেকিস্তান এবং দেশে উৎপাদিত সুতার দাম প্রায় একই রকম হলেও স্থলবন্দর দিয়ে আসা ভারতীয় সুতার দাম অনেক কম থাকে। অর্থাৎ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা সুতা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ঘোষিত দামের চেয়ে অনেক কম দামে আসে। এতে দেশের সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।
সুতা আমদানি বন্ধ করায় বাংলাদেশের কী লাভ
ভারত থেকে সুতা আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা ও কম মূল্যে সুতা রফতানির অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশের বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা। স্থলসীমান্তে বাংলাদেশ কাস্টমসে যে পরিমাণ সুতা আমদানির কথা বলা হয়, এর চেয়ে বেশি সুতা দেশে আসে। লোকবলের অভাবে সশরীরে পরিদর্শন করার সক্ষমতা কম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের। এ সুযোগে ৩০ কাউন্টের সুতার চালানের ভেতরে ৮০ কাউন্টের সুতা আনার অভিযোগও আছে। এনবিআরের এ সিদ্ধান্তে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে সুতা আনা বন্ধ হবে। এতে স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা পাবে। আবার ভারত থেকে সমুদ্রপথে সুতা আমদানি করলে আর্থিকভাবে লাভ হবে। আবার স্থলপথের চেয়ে সমুদ্রপথে সময় খুব বেশি লাগবে না।
জানা গেছে, ভারতের কর্নাটক, তামিলনাড়ু ও গুজরাট থেকে বাংলাদেশে সুতা আসে। সড়কপথে সুতা আসতে ১০-১২ দিন সময় লাগে। অন্যদিকে চেন্নাই সমুদ্রবন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত আসতে সময় লাগে দুই সপ্তাহের মতো। আর সমুদ্রপথে পণ্য এলে তিন-চার দিন বেশি সময় লাগে। কিন্তু জাহাজে সুতা আনলে ভাড়া ১০ শতাংশ কম পড়ে।
এদিকে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) দাবি করেছে, ভারতীয় সহায়তায় কম দামে সুতা রফতানি করে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বাজার নষ্ট করছে, ফলে স্থানীয় শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তাদের মতে, স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ করা বাংলাদেশের স্থানীয় শিল্পের জন্য সুরক্ষা দেবে এবং উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াবে। তারা মনে করে, ভারতের অত্যন্ত কম দামে সুতা রফতানি করায় বাংলাদেশের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়, যা স্থানীয় শিল্পের জন্য ক্ষতিকর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববাজারে সুতা ও টেক্সটাইল সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা এবং এর সঙ্গে সঙ্গে দেশের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। তবে, সমুদ্রপথ ও আকাশপথে সুতা আমদানির ক্ষেত্রে খরচ বাড়ার কারণে নিটশিল্পের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এ পরিস্থিতি সামলাতে বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে যাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য সুতা সরবরাহের সুযোগ নিশ্চিত হয় এবং স্থানীয় শিল্পে নতুন করে প্রাণ ঢালা যায়।
ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের জন্য একাধিক সুফল ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। একদিকে, এটি দেশের স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে সাহায্য করবে এবং উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা এর ফলে সমস্যায় পড়তে পারে, বিশেষ করে তাদের জন্য কম দামে সুতা পাওয়ার সুযোগ না থাকলে তাদের খরচ বৃদ্ধি পাবে। তবে, এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাতে সব স্তরের শিল্পের সমন্বিত বিকাশ সম্ভব হয়।
কেকে/এআর