দেশের বৃহৎ শিল্পগ্রুপগুলোর একটি মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই)। এ গ্রুপের বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলও রয়েছে। বিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তারা। কিন্তু এ শিল্পগ্রুপের বিরুদ্ধে জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারসহ নানান অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে মেঘনা গ্রুপের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নিয়ে নানা তথ্য উঠে এসেছে।
মেঘনা গ্রুপের বিরুদ্ধে গত ২১ বছরে ভ্যাট ও বিমা পলিসি এড়িয়ে ২৫০০ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাতের তথ্য উঠে এসেছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। পাশাপাশি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির ৮৬২ কোটি টাকা বকেয়া রাখারও অভিযোগ মিলেছে গ্রুপটির বিরুদ্ধে। ভ্যাট ও বিমা পলিসিসংক্রান্ত ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, মেঘনা গ্রুপের কর্ণধার মোস্তফা কামাল গত ২১ বছরে (২০০০ থেকে ২০২০ সাল) আমদানিতে ৭৯ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা আন্ডার ইনভয়েসিং, শুল্কায়নযোগ্য পণ্য-মোটরযান-নৌযানের বিপরীতে বাধ্যতামূলক বিমা পলিসি এড়িয়ে গিয়ে ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্সের এক হাজার ৫১৯ কোটি টাকা, সরকারের ভ্যাট, স্ট্যাম্প ডিউটি ও ব্যাংক কমিশনের এক হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেছেন। জানা যায়, গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি এনবিআরকে দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
এ ছাড়া মেঘনা গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে ৮৬২ কোটি টাকা পায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। মেঘনা গ্রুপ বছরের পর বছর ধরে তিতাসের এত টাকা বকেয়া রেখেছে। আওয়ামী সরকারঘেঁষা এ কোম্পানির বিরুদ্ধে এত দিন কেউ কথা বলতে সাহস করেননি। গ্রুপটির কাছ থেকে যখনই কোনো কর্মকর্তা বিল আদায়ের চেষ্টা করেছেন, তখনই তাকে চেয়ার হারাতে হয়েছে। আর সেই সুযোগে বকেয়া গ্যাস বিলকে মূলধন বানিয়ে ফেলেছে মেঘনা গ্রুপ।
তিতাস গ্যাস সূত্র জানিয়েছে, মেঘনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এভারেস্ট পাওয়ার লিমিটেডের কাছে বকেয়া পড়েছে ৭৭০ কোটি টাকা। আর মেঘনা সুগার রিফাইনারির বকেয়ার পরিমাণ ৯২ কোটি টাকা। দফায় দফায় চিঠি দিয়েও বকেয়া উদ্ধার করতে পারছে না তিতাস।
এভারেস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (ক্যাপটিভ) হিসেবে ২০১০ সালে চালু হয়। কোম্পানিটির গ্যাস সংযোগ অনুমোদনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল ওপেন সিক্রেট বিষয়। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সরেজমিন গিয়ে উদ্বোধন করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজে। যা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কর্মকর্তাদের কাছে ছিল বিস্ময়ের। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ওই দহরম-মহরমের কারণে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মেঘনা গ্রুপের কর্ণধার মোস্তফা কামালকে। যা খুশি তাই করে গেছেন। চুক্তির মাঝপথে এসে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতাও বাড়িয়ে নিয়েছেন। শুরুতে কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ মেগাওয়াট থাকলেও ৩ বছর পরে ২০১৪ সালে ৫০ দশমিক ৭০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়। একইসঙ্গে ক্যাপটিভ থেকে স্মল আইপিপি হিসেবে রূপান্তরিত হয়ে যায় এভারেস্ট পাওয়ার।
কেন্দ্রটির উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও মেঘনা ইকোনমিক জোনে অবস্থিত বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে থাকে।
বিইআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে দেওয়া বিদ্যুতের গ্যাসের বিল আইপিপি রেটে এবং বাইরে বিক্রি করা বিদ্যুতের অংশের গ্যাসের দাম ক্যাপটিভ রেটে পরিশোধ করার কথা। কিন্তু বিইআরসির নির্দেশনা অমান্য করে ক্যাপটিভ রেটে গ্যাস বিল প্রদান থেকে বিরত রয়েছে কোম্পানিটি।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেছেন, মেঘনা গ্রুপের বকেয়ার বিষয়টি সমাধান হওয়া দরকার। এ রকম একটি কম্পানির বিল আদায় না হওয়া খুবই দুঃখজনক। তারা বিভিন্ন সময় নানা প্রেসার ব্যবহার করে পার পেয়েছে। এর ফলে বিপুল পরিমাণ বকেয়ার কারণে তিতাস গ্যাস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এখন হার্ডলাইনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। মেঘনা গ্রুপ আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠতাকে পুঁজি করে ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন পণ্য সিন্ডিকেট করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও সরকার ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। আন্ডার ইনভয়েসিং, ভ্যাট ফাঁকি, টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছে গ্রুপটির কর্ণধার মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে। ৮০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত দল গঠন করেছে। গত ৮ এপ্রিল একটি পত্র জারি করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশ দেয় দুদক।
অন্যদিকে, মোস্তফা কামাল, তার স্ত্রী বিউটি আক্তার ও সন্তানদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার খবর পাওয়া গেছে। গত ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। পাশাপাশি তাদের একক নামে পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠান থাকলে তার হিসাবও জব্দ করতে বলা হয়েছে।
বিল খেলাপির পাশাপাশি বিশাল অঙ্কের ব্যাংক ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে মেঘনা গ্রুপের বিরুদ্ধে। গ্রুপটির ৫৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিল খেলাপির তালিকায় থাকা মেঘনা সুগার রিফাইনারির নামে ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছেন ৩ হাজার ১৮ কোটি টাকা। গোয়েন্দা বিভাগ মনে করছে, এর বেশিরভাগ অর্থই নানাভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
এদিকে, মেঘনা গ্রুপের বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতির বিস্তারিত উঠে এসেছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি এনবিআরকে দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এতে বলা হয়েছে, মোস্তফা কামাল গত ২১ বছরে (২০০০ থেকে ২০২০ সাল) আমদানিতে ৭৯ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা আন্ডার ইনভয়েসিং, শুল্কায়নযোগ্য পণ্য-মোটরযান-নৌযানের বিপরীতে বাধ্যতামূলক বিমা পলিসি এড়িয়ে গিয়ে ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্সের এক হাজার ৫১৯ কোটি টাকা, সরকারের ভ্যাট, স্ট্যাম্প ডিউটি ও ব্যাংক কমিশনের এক হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেছেন।
মেঘনা নদীর জায়গা দখল করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, অবৈধভাবে নদী ভরাট করে নদীর গতিপথ ব্যাহত করা এবং অন্যের জমি দখলসহ নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে গ্রুপটির বিরুদ্ধে। প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্তব্য নিতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া দেয়নি মেঘনা গ্রুপ কর্তৃপক্ষ। গ্রুপের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার (ব্র্যান্ড) কাজী মহিউদ্দিন আহমদকে কয়েক দিন সময় নিয়ে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে দেওয়া মেসেজ সিন করলেও কোনো উত্তর দেননি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সক্রিয়ভাবে কাজ করলে রাজস্ব আয় ফাঁকির সুযোগ থাকত না। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এদের সখ্যের কারণে মেঘনা গ্রুপের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, কর ফাঁকি ও অর্থপাচারের তথ্য জানার পরও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এত বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচারের অভিযোগ আমলে নিতে মাসের পর মাস সময় নষ্ট করা বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।
মেঘনা গ্রুপের বিরুদ্ধে জালিয়াতি, অনিয়ম ও অর্থপাচার বিষয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, এ ধরনের একটি প্রতিবেদন আমাদের কাছে এসেছে। প্রতিবেদনে যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোর যথার্থতা নিয়ে কাজ চলছে। মেঘনা গ্রুপ তাদের আমদানিকৃত পণ্যের যে মূল্য ঘোষণা করেছে, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তারচেয়ে আমদানি মূল্য কয়েকগুণ বেশি বলে মনে করছে, যা অস্বাভাবিক। সাধারণত আমদানি মূল্যের সঙ্গে কাস্টমসের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পার্থক্য হতে পারে।
কিন্তু এখানে যে তথ্য রয়েছে, তাতে দেখা যায় এ পার্থক্যের পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি। এখন যদি পণ্যের আমদানি মূল্য বেশি হওয়ার বিষয়টি মেঘনা গ্রুপ স্বীকার করে নেয়, তাহলে তাদের বেশি শুল্ক পরিশোধ করার কথা। মেঘনা গ্রুপের মতো কোম্পানি কী সত্যিই সেটি মেনে নিয়েছে- এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, আমরা তথ্যের যথার্থতা যাচাই করতে এনবিআর চেয়ারম্যানের দফতরে পাঠাব। সেখান থেকে হয়তো সেটি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে পাঠিয়ে তথ্যের সঠিকতা যাচাই করে দেখবে। যদি তথ্যের যথার্থতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়, তাহলে এনবিআর-সংশ্লিষ্ট যে বিষয়টি রয়েছে, সেটির ব্যাপারে আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
কেকে/এআর