দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রধান ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ পুলিশ। তবে এ বাহিনীটির সদস্যদের নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ নতুন কিছু নয়। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি, ঘুস, দুর্নীতি-চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে বাহিনীটির বিরুদ্ধে। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রশাসনকে জনবান্ধব করার লক্ষ্যে নানা সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
পদায়ন আর বদলিতে উলট-পালট করা হয়েছে বাহিনীটির অভ্যন্তরে। এতে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেলেও নিজেদের চরিত্র বদলায়নি পুলিশের সিংহভাগ সদস্য। সুযোগ বুঝে সেই পুরোনো স্বভাবে ফিরছেন তারা। দেশের নানা প্রান্তে পুলিশ সদস্যদের পুরোনো আচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের খবর নতুন করে সামনে আসছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান ও ঠাকুরগাঁও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুর রহমানসহ আরো কিছু পুলিশ কর্মকর্তার সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিতর্কিত ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে অনেকটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত এ বাহিনীটি। যে কারণে ফ্যাসিস্ট আমলের পুলিশি আচরণ এবং বর্তমান পুলিশের আচরণকে মেলাচ্ছে ভুক্তভোগীরা।
সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি শহিদুর রহমানের এক মহিলার সঙ্গে করা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায়- কোন একটি গাড়ির বিষয় নিয়ে ওসির সঙ্গে ভুক্তভোগীর কথা হচ্ছে। এর পর্যায়ে ওসি ভুক্তভোগী মহিলার সঙ্গে উচ্চস্বরে খারাপ আচরণ করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে ওই মহিলার মোবাইল কেড়ে নেওয়ার জন্য তার অধীনস্তদের হাকডাক শুরু করেন এবং মোবাই কেড়ে নেওয়ার জন্য ধ্বস্তাধ্বস্তির বিষয়টিও বোঝা যায়। এ ভিডিও ভাইরাল হলে অভিযুক্ত ওসির নানা দুর্নীতির খবর একের পর এক সামনে আসতে শুরু করে। সংবাদ প্রকাশ হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। ফলে ওই ওসিকে ঠাকুরগাঁও সদর থানা থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে রংপুর রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সে সংযুক্ত করা হয়।
এদিকে ওসি শহিদুর রহমানকে বদলির পরও তিনি থেকে যান আলোচনায়। গতকাল রোববার সকালে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে একটি বিতর্কিত স্ট্যাটাস দেন তিনি। সেখানে লেখেন- ‘মিথ্যা গল্প সাজিয়ে লাভ নেই, উপকার আমারই হবে, প্রতিটি গল্পই এক একটা সাক্ষী। বুঝলে বুঝ, না বুঝলে খেয়ে নে তরমুজ।’ এই স্ট্যাটাসের পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা। স্থানীয়দের অনেকেই অভিযোগ করেন, ওসি শহিদুর রহমানের সময় থানায় সাধারণ মানুষ নিয়মিত হয়রানির শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ অভিযোগ তুলেছেন, মামলা দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ও দাপটপূর্ণ ব্যবহার ছিল তার নিত্যদিনের চিত্র।
এর কয়েকদিন আগে অভিযোগ ওঠে কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলায় ভিডিও এবং ছবি ধারণ করায় তার নির্দেশে এক সাংবাদিকের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে ভিডিও এবং ছবি ডিলিট করা হয়। এরপর ঘটনাটিকে ঘিরে সাংবাদিক সমাজ ক্ষোভ এবং নিন্দা প্রকাশ করেন। ভুক্তভোগী সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম জানান, ঘটনাস্থলে পুলিশ সুপার আসার খবর শুনে সেখানে গিয়ে ভিডিও ও ছবি তোলার সময় এসপি সাহেব আমার ওপর চড়াও হন এবং সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে আমার হাতে থাকা ফোনটি কেড়ে নিতে বললে সঙ্গে থাকা এক পুলিশ সদস্য ফোনটি কেড়ে নিয়ে ছবি ও ভিডিও ডিলিট করেন।
এরপর বিষয়টি সমাধানের লক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারি কর্মকর্তারা সবাইকে ভালো রাখার জন্য কাজ করি। এ ছাড়া পুলিশ-সাংবাদিক আমরা মিলেমিশে কাজ করলে মানুষজন উপকৃত হবে। এটাই আমার বিশ্বাস।’
সাংবাদিকের মোবাইল কেড়ে নিয়ে ভিডিও ডিলেট করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় হরিপুর তিস্তা ব্রিজের পাশে মা-মেয়েকে উত্যক্তের ঘটনাকে কেন্দ্র করে- চিলমারী ও সুন্দরগঞ্জ এলাকার লোকজনের মধ্যে চলমান উত্তেজনা তৈরি হয়। আর এ পরিস্থিতি সমাল দিতে- রাতে জেলা পুলিশের একটি চৌকস টিম অস্ত্র উদ্ধারের বিশেষ অভিযান চালায়। এ সময় একজন অজ্ঞাত তরুণ গোপনে ভিডিও ধারণ করা শুরু করে। বিষয়টি ফাঁস হতে পারে- এ আশঙ্কা থেকে তার মোবাইল হতে ভিডিওটি ডিলিট করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ওই তরুণ সাংবাদিক, এটা আমাদের জানা ছিল না। সুতরাং- বিষয়টি ছিল ভুল বোঝাবুঝি।’
এরও কয়েকদিন আগে- হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজের লাভের অংশ থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক নেতার কাছে জিলাপি খাওয়ার টাকা চান কিশোরগঞ্জের ইটনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনোয়ার হোসেন। এ-সংক্রান্ত একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওসি মনোয়ারকে প্রত্যাহার করা হয়।
ফোনালাপে ওসি মনোয়ারকে বলতে শোনা যায়, ‘সেফটি সিকিউরিটি দিলাম তো সারা জীবন। তোমরা যে ১৮ লাখ টাকার কাজ করে ১০ লাখ টাকা লাভ করলা, ১০ টাকার জিলাপি কিনে তো পাবলিকেরে খাওয়ালে না। খাইয়া যে একটু দোয়া কইরা দেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের। তোমার জায়গায় আমি হইলে সুদের ওপরে টাকা আইনা আগে জিলাপি খাওয়াইতাম। দোয়াডা হইল সবার আগে।’ অডিওতে ওসিকে আরো বলতে শোনা যায়, ‘ঠিক আছে তাহলে, জিলাপির অপেক্ষায় রইলাম, নাকি?’
এ সময় অপর পক্ষ থেকে বলতে শোনা যায়, ‘শুধু জিলাপি না, অন্য কিছু?’ ওসি বলেন, ‘না না, জিলাপি হইলেই হইব। এক প্যাঁচ-আধাপ্যাঁচ জিলাপি দিলে হইব। বিভিন্ন পারপাসে হইলে পাবলিক খাইল আর কী, বোঝ না?’ এ সময় ছাত্রনেতা বলেন, ‘বিলটিল পাই, একটা অ্যামাউন্ট দেব নে।’ এ কথার উত্তরে ওসি বলেন, ‘ঠিক আছে। আচ্ছা, আচ্ছা।’
এসব বিষয়ে শান্ত বলেন, ‘আমার কাছে ওসি সাহেব অনেকবার টাকা চাইছে। ফোনে তো আর সরাসরি বলতে পারে না, তাই একটা ইঙ্গিত ছিল। আপনি দেখেন রেকর্ডিংয়ে আমি বলছি, স্যার বিলটা পেয়ে নিই একটা অ্যামাউন্ট পাঠাইয়া দিমুনে। পরে তিনি আচ্ছা কয়বার বলছে শুইনেন। তিনি সারা ইটনার মানুষের সঙ্গে এমন করতেছে।’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ওসি মনোয়ার বলেন, ‘একটি স্বার্থবাদী মহল সম্ভবত এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমার কণ্ঠ বলে একটি অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করছে। এটা দুঃখজনক।’
অন্যদিকে গত শনিবার গাজীপুরে ট্রাফিকের দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সঙ্গে অসদাচরণ করার অভিযোগ উঠেছে। ওই পুলিশ সদস্যের নাম কামরুল ইসলাম। অভিযোগ সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই প্রক্টর গাজীপুর থেকে উত্তরা আসার জন্য ফ্লাইওভার এ উঠতে চায়। তখনই ট্রাফিকের দায়িত্বরত ওই পুলিশ সদস্য রাস্তাটি বন্ধ করে দেন। ফলে সড়কে জ্যামের সৃষ্টি হয়। আর এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি নারী প্রক্টরের সঙ্গে বাজে আচরণ করেন। এ সময় তিনি- ‘প্রক্টর আর ছাত্র, এসব গোনার টাইম নাই’ বলে মন্তব্য করেন। পরে এ বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্ররা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিলে বিষয়টি ট্রাফিক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমাধান করেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্নস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এমন আরো অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
এসব বিষয়ে কথা হলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের প্রক্টর ম্যাডামের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলা হয়েছে, তা শুধু অশ্রাব্য নয়- এটা পুলিশের এক ধরনের ক্ষমতার দম্ভ। যখন বিচার চাইতে গেলাম, তখন দেখা গেল তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, শুধু মৌখিকভাবে সমাধান।’
অপরাধ বিশ্লেকরা বলছেন, বাংলাদেশে পুলিশ সংস্কারের বড় সমস্যা হলো মনোভাব পরিবর্তনের ঘাটতি। বাহিনীর ভেতর এক ধরনের ‘অসীম ক্ষমতা’ ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, যা তাদের আচরণে প্রতিফলিত হয়। জনণের করের টাকায় পরিচালিত এ বাহিনী যখন জনগণের সেবা না দিয়ে তাদের আতঙ্কের উৎস হয়ে ওঠে, তখন সেটা শুধু প্রশাসনিক সমস্যা নয়, এটা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতীক। পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করে আমরা যত সংস্কারই করি না কেন, ফল হবে শূন্য।’
কেকে/এআর