রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় বিএনপি নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেড়েই চলেছে। নিজেদের মধ্যে একের পর এক সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় থানায় মামলাও রুজু হচ্ছে। দলটির নিজ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রয়েছে সহিংসতার অভিযোগ। একই দলের নেতাদের অন্য নেতারা কুপিয়ে জখম করছেন, ব্যবহার করছেন পিস্তল।
সম্প্রতি যুবদল নেতা জাকির হোসেন বাবুকে কুপিয়ে জখম করেছে দুর্বৃত্তরা। সেখানেও দেখা যায় নিজ দলের নেতাদের দ্বারাই জখম হয়েছেন বাবু।
এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় মামলাও হয়েছে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। মামলার নথিতে দেখা যায় আসামিরা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে মোহাম্মদ আলী আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকলেও এখন বিএনপির হয়ে মাঠে নেমেছেন। অন্য আসামিরা হলেন— মো. ইমন মুন্সী, সজল, রাকিব, বিষ্ণু বিজয়, মো. আল-আমিন, সিদ্দিক, মো. শাকিল, আকরাম। এরা সবাই বিএনপির নেতা বলে জানা যায়।
আহত জাকির হোসেন বাবু খোলা কাগজকে জানান, মামলা করলেও এখনো কোনো আসামি গ্রেফতার হয়নি। হাসপাতালে ভর্তি থেকেও শঙ্কিত রয়েছি, আসামিরা হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপির কয়েকজন নেতা হামলার শিকার হন, এর মধ্যে ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মান্নান হোসেন শাহীনকে, ২৪ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে ৬টার দিকে মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যান তার নিজ অফিসে বসে থাকা অবস্থায় তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। সেখানেও পিস্তল ব্যবহার হয়।
শিয়া মসজিদ এলাকায় বাজারের সভাপতি আবুল হোসেন আবরুকে গত বছরের ১৮ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে পিস্তল দিয়ে দুই রাউন্ড গুলি করা হয়েছিল। আজো উদ্ধার হয়নি সেই পিস্তল।
এর এক–দুই মাস পরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকায় চলতি বছরের ২৪ মার্চ ব্যবসায়ী মনিরের অফিসে ঢুকে গুলি চালিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। সেই মামলায় একজন গ্রেফতার হলেও উদ্ধার হয়নি অবৈধ অস্ত্র।
ছাত্রদল অন্য এক নেতাকে ৩৪নং ওয়ার্ড এলাকায় প্রথমে পিস্তলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে পরে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করা হয়, সেই ঘটনায়ও উদ্ধার হয়নি ব্যবহারিত পিস্তলটি।
এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোহাম্মদপুর এলাকায় অনেকের কাছেই পিস্তল রয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় ব্যবহার হচ্ছে পিস্তল। মামলা হলে দুই-একজন গ্রেফতার হয়, কিন্তু অস্ত্র আর উদ্ধার হয় না।
ছাত্রদল পশ্চিমের সাবেক (সদস্য সচিব) জুয়েল রাজকে চলতি বছরের রমজান মাসে পিস্তল দিয়ে প্রথমে মাথায় আঘাত করে পরে তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করে তারই দলের ৩৪নং ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা। এই ছাত্রদল নেতাকে পিস্তলের বার্ট দিয়ে আঘাত করার অভিযোগ থাকলেও উদ্ধার হয়নি সেই পিস্তলটি।
৩৩নং ওয়ার্ড সভাপতি মান্নান হোসেন শাহীন, শিয়া মসজিদ সংলগ্ন বাজার সভাপতি আবুল হোসেন আবরু, ছাত্রদলের নেতা ব্যবসায়ী মনিরের অফিসে, সর্বশেষ যুবদল নেতা জাকির হোসেন বাবুকে পিস্তল দিয়ে আঘাত করে পরবর্তীতে কুপিয়ে জখম করা হয়। কয়েকটি ঘটনায় দেশীয় অস্ত্রসহ পিস্তল ও ব্যবহার হয়। এতে বোঝা যাচ্ছে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে অনেকের কাছেই পিস্তল সংরক্ষিত রয়েছে।
ভুক্তভোগী জাকির হোসেন বাবু খোলা কাগজকে জানান, তিনি আদাবর থানার ১০০নং ওয়ার্ডের যুবদলের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি। ১৬ বছরের আওয়ামী লীগ আমলে অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কিন্তু এখন আবার হামলার শিকার হচ্ছেন।
তিনি জানান, তার চাচাতো ভাইয়ের একটি সিএনজি গ্যারেজে বিএনপির নেতা, ইমনের সঙ্গে একটা বিষয়ে ঝামেলার সৃষ্টি হলে সেটির সমাধান করতে গেলে তার ওপর দলীয় কর্মীরা হামলা করে।
তিনি আরো জানান, গত ১৪ এপ্রিল ৩টার দিকে শ্যামলী সিনেমা হলের পশ্চিম পাশের সড়ক থেকে ধাওয়া দিয়ে তাকে খিলজি রোডে এনে প্রথমে পিস্তল দিয়ে আঘাত করে পরবর্তীতে তার মাথায় ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে।
বাবু জানান, একজন পিস্তল ঠেকিয়ে বলে, তুই চাঁদাবাজি বন্ধ করবি কীভাবে। এই বলে পিস্তলের বাঁট দিয়ে মাথায় একটি আঘাত করে। এরপর তাকে ধাওয়া দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে মাথায় কোপানো হয়।
বর্তমানে বাবু রাজধানীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সেখানকার চিকিৎসক তার মাথায় মোট ২২টি সেলাই লেগেছে এবং মাথার ভেতরের হাড় কেটে গেছে। আপাতত তাকে ভর্তি রাখা হয়েছে।
জাকির হোসেন বাবুর দাবি, তিনি এলাকার মধ্যে কয়েকটি চাঁদাবাজিতে বাধা দেওয়ায় এই ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানার ৫নং ইউনিটের বিএনপির সভাপতি নূর নবী মোল্লা খোলা কাগজকে মুঠোফোনে জানান, জাকির হোসেন বাবু আমার চাচাতো ভাই। ইমন আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করার প্রতিবাদ করলে তারা ৮–৯ জন মিলে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
মোহাম্মদপুর এলাকার কয়েকজন নেতা খোলা কাগজকে জানান, যারা দীর্ঘদিন যাবৎ বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে তারা এসবের সঙ্গে জড়িত না, তাদের মধ্যে বহিষ্কারের একটা ভয় রয়েছে। যারা পুরোনো নেতা, ত্যাগী নেতা, আওয়ামী লীগের আমলে মামলা ও হামলার শিকার হয়েছে; তারা সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, দখলবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত না। হঠাৎ করে যারা নেতা হয়েছে, তারাই বিএনপির বদনাম করছে, লুটপাট করছে। দলীয়ভাবে এদের প্রতিহত করতে পারলে দলটি ভালো থাকবে।
বিএনপির একাধিক নেতা খোলা কাগজকে জানান, মোহাম্মদপুরে বিএনপির নিজেদের মধ্যে কয়েকটি ভাগ রয়েছে। এজন্য একের পর এক ঘটনা ঘটছে। বিএনপির উচিত এগুলো থামানো।
শুধু মোহাম্মদপুর এলাকায় গত কয়েক মাসে কয়েকটি স্থানে পিস্তল ব্যবহার হলেও এসব ঘটনায় মামলা হলে দুই-একজন গ্রেফতার করা ছাড়া ব্যবহারিত পিস্তল উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশের বিশেষ অভিযানে একাধিক গ্রেফতার হলেও উদ্ধার হচ্ছে না পিস্তল।
তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজানের কাছে এসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের বিষয় জানতে চাইলে তিনি খোলা কাগজকে জানান, কয়কটি ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত পিস্তল ব্যবহার হলেও সেসব অবৈধ অস্ত্রগুলো এখনো উদ্ধার হয়নি। তবে পুলিশ কাজ করছে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে।
তিনি আরো বলেন, মোহাম্মদপুর ছাড়াও তেজগাঁও বিভাগে অন্যানো স্থানেও যেসব স্থানে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে, সেগুলো শনাক্তের চেষ্টা চলছে এবং অস্ত্র উদ্ধারসহ ব্যবহারকারীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। আগামীতে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান রয়েছে বলেও জানান তিনি।
আদাবর থানার স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা খোলা কাগজকে জানান, গত ৫ আগস্টের পর অনেকেই গাড়ি বাড়ি ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছে, আমরা তো আগের মতোই আছি। দলের প্রোগ্রাম নিয়মিত করছি, কিন্তু কিছু নেতার কারণে দলের একের পর এক বদনাম হচ্ছে। দলীয় সিদ্ধান্ত আরো কঠোর হওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরো বলেন, মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনাগুলো বিএনপির অঙ্গসংগঠনের ভেতরে। একে অপরকে মামলা দিচ্ছেন, একে অপরকে হামলা করছেন, পিস্তল ঠেকিয়ে দিচ্ছেন— এগুলো সব নিজেদের মধ্যেই হচ্ছে। এতে নিজেদের দলের বদনাম নিজেরাই করছে।
সচেতন নাগরিকরা বলছেন, বিএনপির ঊর্ধ্বতন নেতাদের আরো কঠোর হতে হবে।
কেকে/এএম