রাজধানীর বনানী এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকের বেশে সংঘবদ্ধভাবে তাণ্ডব চালিয়েছে একদল যুবক। গতকাল সোমবার দুপুরে বনানী ১১ নম্বর রোডে এ সহিংস ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এলাকাজুড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, লাঠিসজ্জিত এসব যুবক নির্বিচারে পথচারী ও বাইক রাইডারদের ওপর হামলা চালায়। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, হামলাকারীরা ভিডিও বা ছবি ধারণ করতে গেলেও সাধারণ মানুষের মোবাইল ও ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে তাদের মারধর করছে।
ঘটনার ধরন ও হামলাকারীদের আচরণ দেখে অনেকেই মনে করছেন, এটি একটি পরিকল্পিত হামলা- যার পেছনে রয়েছে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সক্রিয় অংশগ্রহণ। ধারণা করা হচ্ছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তারা অটোরিকশা চালকের ছদ্মবেশে রাস্তায় নেমে এ তাণ্ডব চালান। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে অটোরিকশা চালকের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। হঠাৎ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকেই। কেউ কেউ বলছেন, রাজনৈতিকভাবে পরিকল্পিত- একটি গোপন প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এসব ছদ্মবেশী চালককে রাস্তায় নামানো হচ্ছে। শহরের পরিবহন খাতের আচরণে হঠাৎ এমন অস্বাভাবিক পরিবর্তন, এটি গভীরভাবে চিন্তার বিষয়। এর সঙ্গে যদি সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক তৎপরতা জড়িত থাকে, তাহলে তা জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন বলেও মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন সূত্র মতে, প্রথমত মামলা ও গ্রেফতার এড়ানো এবং দ্বিতীয়ত ঢাকায় অবস্থান করে দলীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে একজোট হওয়া। সারা দেশের আনুমানিক আড়াই লাখ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এখন রাজধানীতে অটোচালকের ছদ্মবেশ ধারণ করেছে। এদিকে রাজধানীতে মাত্রাতিরিক্ত অটোরিকশা বৃদ্ধি পাওয়া ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজধানীতে ক্রমাগত অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করতে দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের জেলা, উপজেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ঢাকায় অবস্থান করছেন। সম্প্রতি মহামারি রূপ ধারণ রাজধানী ঢাকার বিষফোঁড়ায় পরিণত হওয়া অটোরিকশাচালকর ছদ্মবেশে আ.লীগের লোকেরা গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত আট মাসে মাত্রারিক্ত অটোরিকশাচালকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে রয়েছেন আওয়ামী লীগের জেলা-উপজেলা ও থানা-ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
বনানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ওয়ালিয়ার রহমান জানান, ‘হঠাৎ কয়েকজন তরুণ অটোরিকশার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় লাঠি নিয়ে লোকজনকে মারতে শুরু করে। যা খুবই সন্দেহজনক ছিল, মনে হচ্ছিল- এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনার অংশ।’ মোটরসাইকেলে রাইডশেয়ার করেন মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, ‘আমি মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ কয়েকজন আমাকে ঘিরে ধরে লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রক্ত ঝরতে থাকে।’
পথচারী রোকসানা নূর বলেন, ‘আমি মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরছিলাম। এমন সময় হঠাৎ করে হামলা শুরু হলে আমরা পাশের একটা দোকানে গিয়ে লুকাই। মেয়েটা এখনো ভয়ে কাঁপছে।’ একজন মোবাইল দোকানের কর্মী বলেন, ‘এক ভাই ভিডিও করছিলেন। কয়েকজন এসে তার মোবাইল কেড়ে নিয়ে মাটিতে ফেলে ভেঙে দেয়। পরে তাকেও মারধর করে।’
রিকশাচালক মনির হোসেন বলেন, ‘ওরা দেখতে চালকের মতো, কিন্তু ব্যবহার, আচরণ একেবারেই ভিন্ন। গায়ের ভাষা আর মুখের ভাষা শুনে মনে হচ্ছিল, এরা নতুন কেউ।’
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গুলশান সোসাইটি কয়েকদিন আগে ঘোষণা করে ওই এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করতে পারবে না। কিন্তু সোসাইটির এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি অটোরিকশা চালকরা। তারা গত কয়েকদিন ধরে গুলশানের বিভিন্ন এলাকায় রিকশা চালানোর দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। গতকাল সোসাইটির লোকজন গুলশানের শেষ মাথায় এবং বনানী এলাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আটক করছিল। এতে তারা ক্ষুব্ধ হন। তারা বনানী ১১ নম্বর এলাকায় আন্দোলন শুরু করেন। এসময় যারা আন্দোলনের ছবি ও ভিডিও তুলতে আসেন তাদের লাঠিপেটা করেন তারা।
এর আগে গুলশান সোসাইটির সভাপতি ওমর সাদাত বলেছিলেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই ব্যাটারিচালিত রিকশার নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে নেই। ডিপলোমেটরা নানাভাবে এসব রিকশার দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন- এমন অভিযোগ আমাদের কাছে নিয়মিত আসছে। পাশাপাশি ব্যাটারিরিকশা নিয়ে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনা করে আমরা গুলশান এলাকায় ব্যাটিারিরিকশা চলাচল বন্ধের ব্যাপারে সিটি করপোরেশন ও পুলিশের সহায়তা নিয়ে কাজ শুরু করি।
বনানী থানার পরিদর্শক (অপারেশনস) এ কে এম মইনুদ্দিন বলেন, ‘গুলশান সোসাইটি ব্যাটারিচালিত রিকশা প্রবেশ করতে দিচ্ছিল না। ফলে সকাল থেকেই ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা বিচ্ছিন্নভাবে জমায়েত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আস্তে আস্তে তাদের এগ্রেসিভনেস বাড়ছিল। প্যাডেলচালিত রিকশা দেখলে হামলা করার চেষ্টা করছিল। পরে বেলা একটার দিকে আমরা পরিস্থিতি কন্ট্রোলে নিয়ে আসি।’
বিষয়টি নিয়ে বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মেহেদী হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকরা বনানী ১১ নম্বর রোডে এ তাণ্ডব চালায়। ফলে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।’ রিকশাচালকরা কাউকে মারধর করেছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা আন্দোলনের ছবি ও ভিডিও নেওয়ার চেষ্টা করছে তাদের ধাওয়া দিয়ে তারা লাঠিপেটা করছে।’
ট্রাফিক গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘গুলশান সোসাইটি এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে সোসাইটি কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন ও পুলিশ মিলে যৌথভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। সেখানকার নির্ধারিত নিবন্ধিত কিছু প্যাডেলচালিত রিকশা আগে থেকেই চলাচল করে। বাইরের রিকশা প্রবেশ ঠেকাতে ১১ নম্বর ব্রিজে পুলিশের ক্রাইম বিভাগের একটি চেকপোস্ট ছিল। সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা আটকানো থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। এরপর ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা জমায়েত হলে এবং সোসাইটির প্যাডেলচালিত রিকশা চলাকরাও জড়ো হলে দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সে সময় ১১ নম্বর সড়কে যান চলাচল বিঘ্ন ঘটলেও কিছুসময় পরেই যান চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে যায়।’ ট্রাফিক গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার আবু সায়েম নয়ন বলেন, ‘শুনেছি যারা ছবি তুলতে কিংবা ভিডিও করতে চেষ্টা করেছে এমন কেউ নজরে এলেই মারধর করেছে।’
কয়েকদিন আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, বর্তমানে রাজধানীতে বিষফোঁড়া রূপ নিয়েছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে যাতে মূল সড়কে অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করা যায়, সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ছদ্মবেশের বিষয়ে ডিএমপির এই মুখপাত্র জানান, আমরা নগরবাসীর নিরাপত্তায় বাড়তি টহল-পেট্রোলিংয়ের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি। রাজধানীতে ছদ্মবেশে যাতে কেউ অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সে বিষয়েও সতর্ক রয়েছি। সব অপরাধীর ক্ষেত্রে ডিএমপি কঠোর। প্রতিনিয়ত তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
কেকে/এআর