ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে এ বৈঠক করেছে বিএনপি।
এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ, ১২-দলীয় জোট, লেবার পার্টিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপি নেতারা বৈঠক করে। গত শনিবার গুলশানে ১২-দলীয় জোট ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সঙ্গে বৈঠক করে দলটি। এরপর রোববার গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠক হয় দলটির। ধারাবাহিকভাবে ১২-দলীয় জোটসহ বিভিন্ন দল ও জোটের সঙ্গে এ বৈঠক চলমান। তবে এখনই আন্দোলন অথবা কর্মসূচি নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে চাচ্ছেন না বিএনপি নেতারা। তারা চায় ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে, এমনটা ধরে একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করা হোক। সরকারও বলেনি যে, ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে না। সরকার বলছে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ (রূপরেখা) না পেয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং মিত্র দলগুলোর মতামত জানতে চায় বিএনপি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মতামত ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আদায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলনে রাজি নয়। দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর তারা চাপ রাখতে চায়। এ জন্য তারা সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকতে চায়। তাদের বিশ্বাস ড. মুহাম্মদ ইউনূস চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেবে। কারণ অন্তর্বর্তী সরকারকে তারা শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছে। ফলে বর্তমান সরকার বিশ্বাসের মর্যাদা দেবে বলে আশা প্রকাশ করছেন তারা।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে তৃতীয় পক্ষ ফায়দা লোটার চেষ্টা করবে। তাই এখনই তারা সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচিতে একমত নন। এ ছাড়া ঢাকায় আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল বড় হওয়ার বিষয়টি বৈঠকে গুরুত্ব পেয়েছে।
গত বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেও নির্বাচনের রোডম্যাপ (রূপরেখা) পায়নি বিএনপি। বৈঠক নিয়ে দলটি একেবারেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি। বিএনপির নির্বাচনের দিনক্ষণ চাওয়ার জবাবে প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ দেননি। ‘২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন’ বরাবরের মতো একই কথারই পুনরাবৃত্তি করেন সরকারপ্রধান। বৈঠকে অসন্তুষ্ট বিএনপি তাদের মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছিল।
যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সরকারপ্রধানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় কী ফলাফল এসেছে, বিএনপি মূলত সেটি জানানোর জন্যই শরিকদের সঙ্গে বসেছে। নির্বাচন এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে তাদের মতামত নিচ্ছে, যা পরে নিজস্ব ফোরামে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি।
জানতে চাইলে ১২-দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, আমাদের এই মুহূর্তে আন্দোলনের কোনো পরিকল্পনা নেই। আমরা জনমতের বাইরে যেতে চাই না। বৈঠকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে একমত হয়েছি। আর তা আদায়ে সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের কথা হয়েছে। এ লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক উপায়ে কিছু সভা-সমাবেশ করে জনমত গঠনের চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, কেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন জরুরি, তার বাস্তবিক দিক জনগণের কাছে তুলে ধরা হবে। জানুয়ারিতে রমজান কাছাকাছি চলে আসবে। ফেব্রুয়ারি, মার্চ চলে যাবে রোজা ও ঈদের মধ্যে। এপ্রিল থেকে কাল বৈশাখী ঝড়, পরে বর্ষা-বাদল শুরু হয়ে যাবে।
এদিকে বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারের মধ্যে ও সরকারের সমর্থক একটি গোষ্ঠী নির্বাচন বিলম্বিত করতে সক্রিয় হয়েছে। এ জন্য ডিসেম্বরেই নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে সব দলকে এক জায়গায় আনতে কাজ শুরু করেছে দলটি।
বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। আমরাই তো এ সরকারকে সমর্থন দিয়েছি। আমরা মূলত সরকারের কাছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছি। নির্বাচনের জন্য যা যা প্রস্তুতি প্রয়োজন, তা ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছে বলে মনে করি। ফ্যাসিবাদের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার করতে হবে।
তিনি বলেন, যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তাদের বিচার সম্পূর্ণ করার কথাও বলেছি। আমরা কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বাকি জোট ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, ‘কথা হলো- অনেকেই তো বলে বেড়াচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আরও বেশি দিন থাকা দরকার। সংস্কার না হলে নির্বাচন হবে না। আমরাই তো দুই বছর আগে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি।’
তিনি বলেন, হাসিনা সরকার যদি স্বাভাবিকভাবে পদত্যাগ করত, তাহলে একটা সরকার গঠন হতো। সেই সরকার নির্বাচন করত। সেই সরকার গঠনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে কমিশনের যেহেতু বাধ্যবাধকতা আছে। তাহলে এখন নির্বাচন কমিশনের পাঁচ বছর, ১০ বছর লাগবে কেন? কেন তারা তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে পারবে না। হাসিনার সংশোধিত সংবিধানে যতটুকু নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আছে ততটুকু ক্ষমতা দিয়ে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব।
তিনি বলেন, জনগণ যে দেশের মালিক এটা ভোটের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। নির্বাচন দিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলবেন একটা, তার উপদেষ্টারা বলবেন একটা, পাবলিক কার কথা বিশ্বাস করবে- প্রশ্ন রাখেন গয়েশ্বর।
লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার গত আট মাস দায়িত্বপালন করছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আমরা সকল রাজনৈতিক দল মিলে সমর্থন দিয়েছি। তিনি আমাদের একটি সুষ্ঠু, সুন্দর এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেবেন এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিশেষ কারণে স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব নিয়েছে ড. ইউনূস। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তিনি বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ায় আমরা গর্বিত। আশা করি- তিনি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেবেন।
কেকে/এআর