গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনাসহ দলটির বেশিরভাগ শীর্ষ নেতা। ক্ষমতায় থাকাকালীন বিদেশে তৈরি করা ‘সেকেন্ড হোমে’ আশ্রয় নিয়েছেন তারা। সেখান থেকেই এখন সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিভিন্ন উপলক্ষে একসঙ্গে মিলিত হতেও দেখা যাচ্ছে এসব নেতাদের।
ক্ষমতা হারালেও বিদেশে আরাম-আয়েশ আর ভোগ-বিলাসে জীবন কাটছে তাদের। কিন্তু অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই দিনাতিপাত করছেন তারা। মামলা-হামলা ও গ্রেফতার আতঙ্কে আত্মগোপনে অনেকেই। তাছাড়া জীবিকা নির্বাহে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর-নগরে অটোরিকশা ও বাইক রাইডিংয়ের পেশা বেছে নিয়েছেন কেউ কেউ। কত দিনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন- তা নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত, দিশাহীন হয়ে পড়েছেন এসব নেতাকর্মী। তবে বিদেশে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিলাসী জীবন দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তৃণমূল পর্যায়ের অসহায় ও নিরাপত্তাহীন নেতাকর্মীরা।
সম্প্রতি লন্ডনে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুকের ছেলে ফাইয়াজ রহমানের বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা গেছে পতিত আওয়ামী সরকারের সাবেক অন্তত চারজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে। যেখানে নেতার ছেলের বিয়ে উপলক্ষে একসঙ্গে মিলিত হয়ে ভূরিভোজ সারতেও দেখা গেছে তাদের।
দামি গাড়িতে করে একে একে নামছিলেন স্যুট পরা ব্যক্তিরা। স্থানটিও ছিল অনেক দামি। সন্ধ্যার আলো ঝলমলে সাজানো লন্ডনের ওটু এরিনার প্রেস্টিজিয়াস ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের হলরুমে ঢুকছিলেন অতিথিরা। অতিথিদের লাইনেই ছিল ছবি তোলার হিড়িক। মনে হচ্ছিল কেউ একজন বা কয়েকজন ভিআইপি অতিথি আছেন। এভাবেই একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের পলাতক সাবেক মন্ত্রী ও এমপিরা। বিয়ের অনুষ্ঠানে ২০ এপ্রিল সন্ধ্যায় যোগ দেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রহমান, সাবেক প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী, সাবেক নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সিলেট-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব। বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া মন্ত্রীরা বেশ হাসিখুশি ছিলেন। তারা বিয়েতে আগত নেতাকর্মীদের সঙ্গে হেসে কথা বলছিলেন। অনেকের সঙ্গে ছবিও তুলেছেন।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আট মাস পর আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক চার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে এই প্রথম একসঙ্গে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা গেল। এর আগে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর লন্ডনে শেখ হাসিনার ভার্চ্যুয়াল সমাবেশে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে দেখা যায় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আবদুর রহমান এবং সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরীকে।
এ বছরের ২ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে আওয়ামী লীগের কর্মী সমাবেশে দেখা যায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে। ৩০ মার্চ লন্ডনে ঈদের জামাতে প্রকাশ্যে আসেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। আগে থেকে গুঞ্জন ছিল তিনি বেলজিয়ামে ছিলেন। লন্ডনে অধ্যয়নরত ছেলের সঙ্গে ঈদ করতে তিনি লন্ডনে আসেন।
পালাতক মন্ত্রী-এমপিদের এমন আনন্দঘন পরিবেশে দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীরা। তাদের প্রশ্ন, লাখ লাখ নেতাকর্মীকে বিপদের মুখে ফেলে পালিয়ে এসে তারা কীভাবে এসব অনুষ্ঠানে অংশ নেন?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাজ্য যুবলীগের এক নেতা জানান, দেশে আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে বিপদের মুখে ফেলে পালিয়ে এসে তারা কীভাবে এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন, তা ভাবতেও লজ্জা লাগে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অত্যন্ত অসহায় ও নিরাপত্তাহীন এবং অধিকাংশ সময়ই পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনকি অনেকে ৫ আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত বাড়িতে আসতে পারেননি বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। ঈদের সময়েও অনেকে নিজ বাড়ি যেতে এবং স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারেননি।
সরকার পতনের পর দলের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায়ের অনেক নেতা, সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা অনেক নেতাকর্মী জীবিকার প্রয়োজনে নিরুপায় হয়ে পড়েছেন। কিন্তু প্রকাশ্যেও আসতে পারছেন না। প্রকাশ্যে এলেই হামলা হতে পারে, এই ভয়ে এখনো আত্মগোপনে থেকে কষ্টের দিন কাটাচ্ছেন। নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঝুঁকি এখনো কাটেনি, বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আরো কতদিন এভাবে চলবে, তা জানেন না তারা। সহসা সংকট কাটবে, এমন আশাও করতে পারছেন না। এমন কঠিন করুণ পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে পড়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অজ্ঞাত স্থানে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, দলের শীর্ষ পর্যায়ের দুই-একজন নেতা কখনো কখনো হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তারাও সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারছেন না। সংকট কত দিনে কাটবে, তারা সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারেন না!
বিপদগ্রস্ত নেতার্মীদের অনেকে তাদের করুণ পরিস্থিতির জন্য দলের প্রভাবশালী নেতাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে যারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে বিদেশে চলে গেছেন এবং তারা স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন বলে বিপদে থাকা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কেউ কেউ মনে করছেন। কোনো কোনো নেতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে মাঝে মাঝে যোগাযোগ, খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করলেও অনেকেই কর্মীদের কোনো খোঁজ-খবর রাখেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে অনেকেই নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন।
যদিও দলের পক্ষ থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে এক নির্দেশনায় দলের প্রতিটি নেতাকর্মীর খোঁজ-খবর এবং তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। এসব তথ্য সংগ্রহ করে দলের ইমেইল ও টেলিগ্রামে পাঠাতে বলা হয়েছে। জানতে চাওয়া তথ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে-কতজন দলীয় নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি না, জেলায় মোট কতগুলো মামলা হয়েছে- এর মধ্যে জিআর, সিআর ও আইসিটি মামলার সংখ্যা কত, কতজন নেতাকর্মী কারাগারে আছেন, আহত নেতাকর্মীর সংখ্যা কত, তারা কোথায় চিকিৎসা নিচ্ছেন, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং নিজ আসনের সংসদ সদস্যদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সর্বশেষ আপডেট কী ইত্যাদি বিষয়।
এদিকে বিদেশে ফুর্তি করা আওয়ামী লীগের নেতাদের কঠোর সমালোচনা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা বিদেশে আমোদ-ফুর্তি করছেন তাদের প্রত্যেকের হাতে রক্ত লেগে আছে। তারা দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে নিয়ে গেছে। সোমবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। শফিকুল আলম জানান, যারা হত্যা ও দুর্নীতি করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন, তাদের ফিরিয়ে আনা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। পলাতক সব এমপি মন্ত্রীদের আইনের আওতায় আনা হবে। সরকার সেই চেষ্টা করবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বাংলাদেশে এখন গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করছে। সবাই সবার মতপ্রকাশ করতে পারছি। তবে কোনোভাবেই ফ্যাসিবাদী শক্তিকে প্রবেশ করতে দেব না, সে ব্যাপারে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ। গত রোববার খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আন্তদলীয় আলোচনায় বসে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক এসব কথা বলেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দীর্ঘ সময় দলটির নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে থাকলেও সম্প্রতি রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে দলটির নেতাকর্মীরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঝটিকা মিছিলও করছে। এ অবস্থায় কোনোভাবেই যাতে ফ্যাসিবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিতে না পারে তাই রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান এনসিপির আহ্বায়ক।
এদিকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো দলটির বেশিরভাগ নেতা এখন অবস্থান করছেন প্রতিবেশী দেশ ভারতে। সেখানে সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। সেখানে থেকে বাংলাদেশে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনাও দিচ্ছেন এসব নেতা। যা মেনে সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মিছিলও করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
কেকে/এআর