জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ঐতিহাসিক নান্দাইল দীঘি। প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের দীঘিটি কালাই উপজেলার পুনট ইউনিয়নে ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে খনন করা হয়। বিশাল আয়তনের এ দীঘির রয়েছে স্বতন্ত্র ইতিহাস। দীঘির নির্মাণ ও কারুকাজ বিমোহিত করে ইতিহাসপ্রেমীদের। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য এটি খুবই আকর্ষণীয় প্রত্নকীর্তি। এলাকার নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো থাকায় সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে এখানে। শীতে নানা ধরনের পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে দীঘির স্বচ্ছ পানিতে।
ঈদ আনন্দসহ সব উৎসবে পর্যটকদের আগমন ঘটে এখানে। এছাড়া পর্যটক থাকে সারা বছরই। তাই নান্দাইল দীঘিকে পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তর এখন সময়ের দাবি। দীঘিটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা না দেওয়ায় প্রতিবছর সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।
নান্দাইল দীঘির নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, করতোয়া নদী খনন করার ফলে এ অঞ্চলের পানি ওই নদীতে নেমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে মাঠ, ঘাট শুকিয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যেত এক সময়। চারদিকে পানির অভাবে খাঁ খাঁ করত এ এলাকা। সে সময় প্রজাদের দুঃখের কথা ভেবে রাজা নন্দলাল ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে এ দীঘিটি খনন করান। রাজা নন্দলাল থেকেই নান্দাইল দীঘির নামকরণ হয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে, এ দীঘিটি লাখো শ্রমিকের মাধ্যমে এক রাতে খনন করা হয়েছিল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত দীঘির তলদেশে কী আছে তাও বলতে পারে না কেউ।
এ দীঘির আয়তন প্রায় একশ একর অর্থাৎ তিনশ বিঘা। এর মধ্যে প্রায় ১৮০ বিঘা জলকর। স্বচ্ছ পানির দীঘিটি প্রায় ১ কিলোমিটার লম্বাও বটে, আবার গভীরও বেশ।
দুই যুগ আগেও দীঘির চতুর্দিকে ছিল দৃষ্টিনন্দন উঁচু-নিচু টিলা। যা ছিল সবুজ শ্যামল বৃক্ষে পরিবেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। গত ১৬ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের সময় দৃষ্টিনন্দন উঁচু-নিচু টিলাগুলো মাটি কেটে ইটভাটাসহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হয়। ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কিছুটা ভাটা পড়েছে। এছাড়া ওই সময়ে দীঘির চারপাশের পাড়ের জায়গা দখলের ঘটনাও ঘটেছে। পাড়ের ওপর গড়ে উঠেছে ঘড়বাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
কালভেদে প্রতিদিন অসংখ্য দেশি-বিদেশি পাখি, সাইবেরিয়ান হাঁস, অস্ট্রেলিয়ান হাঁস, বুনো হাঁস, সারস, কাউন পাখি, বকের সারি, রাজহাঁস, চীনা হাঁসসহ নাম না জানা বিভিন্ন প্রজাতির রংবেরঙের পাখি এখনো দৃষ্টি কাড়ে। শীত মৌসুমে এদের আগমনে জেগে ওঠা চর ও স্বচ্ছ পানিতে এক অনন্য দৃশ্যের অবতারণা হয়।
রাতে দীঘিটি হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় ও মনোরম। চাঁদনি রাতে চাঁদের আলোতে মৃদু বাতাসে দীঘির স্বচ্ছ পানি সোনা-রুপার মতো ঝলমল আলো দিয়ে প্রকৃতিপ্রেমীকে আহ্বান জানায়। বগুড়া-জয়পুরহাট আঞ্চলিক মহাসড়কের উত্তর পাশে আধা কিলোমিটার দূরত্বে দীঘিটি অবস্থিত। বগুড়া বা জয়পুরহাট থেকে বাসে পুনট বাসট্যান্ডে নামতে হবে। সেখান থেকে অটোভ্যানে এক কিলোমিটার দূরে গেলেই দীঘিটির দেখা মিলবে।
স্থানীয়রা জানান, নান্দাইল দীঘিকে পর্যটন স্থান হিসাবে গড়ে তোলা দরকার। এজন্য প্রয়োজন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা। এছাড়া পর্যটকদের থাকার জন্য বিশ্রামাগার, রেস্টুরেন্ট, কৃত্রিম চিড়িয়াখানা, পুলিশ বক্স, ফুলের বাগান, গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত পরিমাণ স্পিডবোট ও এপার থেকে ওপারে যাতায়াত করার জন্য একটি ওভারব্রিজ স্থাপন করলে ভালো হয়।
কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামিমা আক্তার জাহান দৈনিক খোলা কাগজ বলেন, বর্তমানে নান্দাইল-দীঘিটির মোটামুটি উন্নয়ন হয়েছে। ইতোমধ্যে পর্যটক থাকার জন্য একটি মাঝারি ধরনের বিশ্রামাগার, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, একটি ছোট ধরনের গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা, পাকা প্রবেশপথ, একটি স্পিডবোট, দুটি নৌকা, বসার জন্য একটি ছোট ধরনের টিনের গোলঘর এবং বড়-ছোট মিলে তিনটি ঘাট স্থাপন করা হয়েছে। নান্দাইল দীঘির জন্য আগামী অর্থবছরে জেলা পরিষদ থেকে একটি বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। সেখানে চারপাশে একটি প্রাচীর নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
কেকে/ এমএস