সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া দলটির কর্মীদের ওপর বাড়ছে সহিংস হামলা। সাম্প্রতিক বেশকিছু হত্যাকাণ্ড নিয়ে স্থানীয় মানুষ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা ও বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করারও ঘটনা রয়েছে। পুরো পরিস্থিতিতে ছড়িয়ে পড়েছে এক ধরনের আতঙ্ক।
আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং চাঁদাবাজির কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে। যদিও আইনশৃঙ্ঘলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে গুলি করে, কোথাও কোথাও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
মঙ্গলবার ফেনীর সোনাগাজীতে আবুল হাসেম (৫০) নামের এক বিএনপি কর্মীকে বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তার একটি হাত ও পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। দুর্বৃত্তরা বোরকা পরে এ হামলা চালান। এ ঘটনায় পুলিশ একজনকে আটক করেছে। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ওলামা বাজারসংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আবুল হাসেম উপজেলার চরদরবেশ ইউনিয়নের উত্তর চরদরবেশ গ্রামের আবদুর শুক্কুরের ছেলে। কয়েক বছর ধরে তিনি পরিবার নিয়ে সোনাগাজী পৌর এলাকার পশ্চিম বাজারে একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বোরকা পরিহিত ২০ থেকে ২৫ ব্যক্তি পূর্বপরিকল্পিতভাবে ওলামা বাজার এলাকায় আবুল হাসেমের পথরোধ করে। এরপর তাকে একটি বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ধারালো অস্ত্র দিয়ে বাম হাত ও একটি পা কুপিয়ে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। তার মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে জখমের চিহ্ন রয়েছে। স্থানীয়রা হাসেমকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সোনাগাজী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বায়েজীদ আকন বলেন, রাসেল নামের একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।
এদিকে আধিপত্য বিস্তারের জেরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নড়াইলের লোহাগড়ায় ইউনিয়ন বিএনপির এক নেতার ডান হাতের কবজি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন প্রতিপক্ষের লোকজন। গতকাল বেলা একটার দিকে উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের সারুলিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় বিএনপির ওই নেতার ভাইসহ আরো দুজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের রাউজানে দুই দিনের ব্যবধানের পর পর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে। আধিপত্যবিস্তারকে কেন্দ্র করে মুহাম্মদ ইব্রাহিম নামে আরো এক যুবদলকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। গতকাল দুপুর দেড়টায় রাউজান সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের গাজীপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত ইব্রাহিম ওই এলাকার মুহাম্মদ আলমের ছেলে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দুটি অটোরিকশায় করে ১০ থেকে ১২ জনের একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী তার মাথায় ও বুকে গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ সময় তার বাবা মুহাম্মদ আলম ও চাচা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হালিমকে লক্ষ্য করেও গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসীরা। গায়ে গুলি না লাগলেও পালাতে গিয়ে পড়ে তারা আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসা উদ্ধার করেছে পুলিশ।
এর আগে গত শনিবার রাতে উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের গরিব উল্লাহপাড়া গ্রামের ভান্ডারি কলোনির একটি বাসায় ভাত খাওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা যুবদলকর্মী মুহাম্মদ মানিক আবদুল্লাহকে (৩৬) গুলি করে হত্যা করে। নিহত মানিক আবদুল্লাহও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন। দুই দিনের ব্যবধানের পর পর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঘটেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুপুরে মুহাম্মদ ইব্রাহিম তার বাড়ির দেড় কিলোমিটার দূরে একটি দোকানের সামনে বসেছিলেন। এ সময় হঠাৎ একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী তিনটি অটোরিকশায় এসে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার মাথা ও বুক লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। এ সময় ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, মুহাম্মদ রায়হান নামের একজন সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে বলে তারা প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। উল্লেখ্য, রাউজানে গত ৫ আগস্টের পর সহিংসতায় মোট ১২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৮টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। বিএনপির দুপক্ষে সংঘর্ষ হয় অন্তত শতাধিকবার। ৩০০ এর বেশি মানুষ এসব ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন।
এদিকে গত শনিবার রাজধানীর বনানীতে ‘ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ’ নিয়ে বিবাদের জেরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ও প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজকে ছুরিকাঘাত করে হত্যার ঘটনা ঘটে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী পারভেজকে হত্যার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা জড়িত। গত রোববার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ তুলে হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি জানান ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম।
এ ছাড়া গত ১৮ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব আজাদ হোসেনকে হাতুড়িপেটা করা হয়। উপজেলা মসজিদে জুমার নামাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে পৌর শহরের থানার মোড় এলাকায় জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের কিছু নেতাকর্মী তার ওপর এ হামলা করেন বলে অভিযোগ বিএনপির। গত ২৯ মার্চ খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি মো. শাহ আলম মোল্লা (৬৫) ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত করা হয়।
মানবাধিকার সংগঠক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং পুলিশের একজন সাবেক প্রধান বলছেন, পুরো ঘটনায় সামাজিক ও মানসিক অস্থিরতার পাশাপাশি ক্ষমতা প্রদর্শন, নিজের হাতে শাস্তি দেওয়ার প্রবণতা এবং বিচারহীনতার প্রতিফলন ঘটেছে।
কেকে/ এমএস