গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশের পর থেকেই দলটির শীর্ষ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। এমন অবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে এরই মধ্যে দলের এক কেন্দ্রীয় নেতাকে দল থেকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছে। গত বছর পাঠ্যবই ছাপানোর কাজে দুর্নীতি-অনিয়ম এবং জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপের অভিযোগে গত সোমবার রাতে এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়। 

এ ছাড়া গত মার্চে দলটির শীর্ষ নেতা সারজিস আলম নিজ এলাকায় বিশাল গাড়িবহর নিয়ে শোডাউন দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা তৈরি হয়। চলতি মাসে হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা দেখা যায়। 

রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কিংবা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ঘোষণা দিয়ে গত ফেব্রুয়ারির শেষে আত্মপ্রকাশ ঘটে তারুণ্যনির্ভর রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে ও পরে দলটির কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সচিবালয়সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ, বদলিবাণিজ্য কিংবা চাঁদাবাজির মতো অভিযোগ ওঠে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বললেও দলটির অনেক নেতাকর্মীই দুর্নীতি অনিয়মের পুরোনো পথেই হাঁটছে। বিষয়টি পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদান আমাদের ভেতরও আসার চেষ্টা করছে। আমরা সেটাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনছি।  

গত শুক্রবার দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় শীর্ষ কয়েকজন নেতার বিলাসী জীবনযাপন, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড কিংবা অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন দলীয় নেতারা। সেখানে সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহসহ কয়েকজন নেতাদের নাম উল্লেখ না করলেও তাদের অভিযোগগুলো নিয়ে কথা বলেন কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ কেউ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতি করতে গেলে যে কৌশল ও পরিপক্বতা দরকার তা অনেক নেতার মধ্যেই নেই। যে কারণে শুরুতেই নতুন দলটিকে ঘিরে নানা বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। 

জাতীয় নাগরিক পার্টির দুই শীর্ষ নেতা উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠন সারজিস আলম ও দক্ষিণের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ। জুলাই আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় প্রথম সারির সমন্বয়ক ছিলেন তারা দু’জনই। আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরই বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের দু’জনই বেশ পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ পদ ও পরে এনসিপিরও গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন তারা। 

গত মার্চে ঈদের আগে বিশাল গাড়িবহর নিয়ে নিজ এলাকা পঞ্চগড়ে শোডাউন দেন সারজিস আলম। তার এই গাড়িবহরের বিশাল শোডাউন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা সমালোচনা তৈরি হয়। তখন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা তাসনিম জারা বিষয়টির সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্টও করেন। গত ৯ এপ্রিল হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম দুর্নীতি দমন কমিশনে যান। এই বিষয়টি নিয়ে তখন নানা ধরনের আলোচনা দেখা যায়। যদিও ওইদিন তারা দুইজন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন- তারা ব্যক্তিগত কাজেই গিয়েছিলেন দুদকে। এর আগেও সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে এই দুই নেতা ফেসবুকে দুটি স্ট্যাটাস দিলে তা নিয়ে বেশ বিতর্ক তৈরি হয় দল ও দলের বাইরে। 

গত কয়েক মাস ধরেই এই দুই নেতার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় কমিটি সূত্রে জানা গেছে। 

শীর্ষ কমিটির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা যে পরিবর্তনের রাজনীতির কথা বলে মানুষের কাছে যেতে চাচ্ছি, কখনো কখনো কোনো কোনো নেতার এসব কর্মকাণ্ডে তা হোঁচট খাচ্ছে।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম বলেন, কারো বিরুদ্ধে যখন কোনো অভিযোগ ওঠে তখন তার স্বপক্ষে প্রমাণ থাকতে হয়। তানভীরের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর কোনো উপযুক্ত প্রমাণ না পাওয়ায় এতদিন ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। শুক্রবারের এনসিপির সাধারণ সভায় এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার পর গত রোববার রাতেই দলের নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে শৃঙ্খলা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সোমবার রাতে এসব অভিযোগের কথা উল্লেখ করে যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি ও কারণ দর্শানো নোটিসও দেওয়া হয়। 

দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমাদের শীর্ষ নেতৃত্ব ভুল করলে বা সমালোচনা করলে আমাদের একজন কেন্দ্রীয় নেতা তাকে প্রশ্ন করতে পারছেন। সেই প্রশ্নের জবাবও প্রকাশ্যে দিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের কারো বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের আর্থিক অনিয়ম, চাঁদাবাজি বা দুর্নীতির বিষয়ে প্রমাণ পেলে যেন আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়। আমরা এ নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। 

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও বর্তমান যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গত কয়েক মাসে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। সোমবার তাকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। 

গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে মোয়াজ্জেম হোসেন দাবি করেছেন, তাকে অপসারণ করা হয়নি বরং তিনি নিজেই পদত্যাগ করেছেন।
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মেডিকেল দলের সদস্য বর্তমান স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তুহিন ফারাবীকে নিয়েও মন্ত্রণালয়ে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া সচিবালয়সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ, বদলিবাণিজ্য কিংবা চাঁদাবাজির মতো অভিযোগও উঠছে এনসিপির কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে। 

বাংলাদেশে গত তিন দশকে বেশ কিছু নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে নতুন এই দলটিকে ঘিরে নানা প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক নানা বিতর্কিত ও নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে শুরু থেকেই দলটির বিরুদ্ধে নানা প্রশ্ন উঠছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এই ছাত্রনেতাদের বয়স কম কিন্তু তাদের ম্যাচিউরিটিরও দরকার আছে। তাদের পরিণত আচরণ করা উচিত। তা না হলে তাদের এসব ভুলের সুযোগ নেবে প্রতিপক্ষরা। 

সূত্র : বিবিসি

কেকে/ এমএস