মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫,
১৬ বৈশাখ ১৪৩২
বাংলা English

মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
শিরোনাম: অভিনেতা সিদ্দিককে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ, ভিডিও ভাইরাল      বিজিবির পা ধরে ক্ষমা চাইলো বিএসএফ      আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পুলিশের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ: প্রধান উপদেষ্টা      পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা      জামিন নামঞ্জুর করে শাহরিন তুহিনকে কারাগারে প্রেরণ      আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলেন শাহরিন তুহিন      তাইজুলের ছয়ে ২২৭ রানেই থেমে গেল জিম্বাবুয়ে      
মুক্তমত
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা
মিল্লাত হোসেন
প্রকাশ: সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫, ৬:৪৮ পিএম  (ভিজিটর : ২৩৯)
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

দলীয় সরকারের বদলে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ধারণা— সেটা উদ্ভাবনের কৃতিত্ব কোনো গণতান্ত্রিক নেতা নয় বরং পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের। ১৯৭৭ সালে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর অধীনে অনুষ্ঠিত বিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচনে কারচুপি, জাল-জালিয়াতির যে পরাকাষ্ঠা দেখা গিয়েছিল, তার জেরে সারা দেশে আন্দোলন-সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। যার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে সেনাপ্রধান জিয়া অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন ৯০ দিনের মধ্যে ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো গ্রেফতার হন।

পরে একটি হত্যামামলায় ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বিচারের মাধ্যমে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। কিন্তু প্রতিশ্রুত নির্বাচনটি আর দেওয়া হয়নি ১৯৮৫ সালের আগে। সে বছর সম্পূর্ণ অভিনব এক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলবিহীন নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়, যা প্রধান রাজনৈতিক নেতারা বয়কট করেন। ফলে, জিয়ার প্রতি অনুগত ব্যক্তিরাই নির্বাচিত হন এবং মোহাম্মদ খান জুনেজোর নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হয়। তার আগে, নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে ১৯৮৪ সালের এক প্রহসনের গণভোটের মাধ্যমে জিয়া নিজেই রাষ্ট্রপ্রধান ‘নির্বাচিত’ হয়ে ১৯৭৩-এর সংবিধান পুনরুজ্জীবিত করে ৪৮(৫) অনুচ্ছেদে বিধান করা হয়— যদি রাষ্ট্রপ্রধান আইনসভা ভেঙে দেন, তাহলে ভেঙে যাওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি নিজ বিবেচনায় ‘একটি তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রিসভা নিযুক্ত করবেন’। ১০৫ (৩) অনুচ্ছেদে প্রাদেশিক সরকারের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপ্রধানের পূর্বানুমোদনক্রমে প্রদেশের গভর্নরকর্তৃক একটি ‘তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রিসভা’ নিযুক্তির বিধান রাখা হয়। এভাবে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যুক্ত করা হলেও বিস্তারিত কাঠামো ছিল না।

১৯৮৮ সালে প্রথমবার এ বিধান প্রয়োগের সুযোগ আসে যখন ক্ষমতার দ্বন্দ্বের এক সন্ধিক্ষণে জিয়া কেন্দ্রীয় আইনসভা ভেঙে দিয়ে জুনেজোর মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু, তিনি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ছাড়াই ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির গণতন্ত্রের গুরুতর ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিজেই রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হয়ে যান। এসব নিয়ে মামলা হয় সুপ্রীম কোর্টে। ইতোমধ্যে বিমান দুর্ঘটনায় সেনাশাসক জিয়া নিহত হলে সংবিধান অনুযায়ী আইনসভার উচ্চকক্ষ সিনেটের সভাপ্রধান গোলাম ইসহাক খান অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হন। তিনি জিয়ার প্রধানমন্ত্রীবিহীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারই বহাল রেখে নির্বাচনের আয়োজন করেন। যে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্ভব, তার ঘোরতর ব্যত্যয় ঘটিয়ে সরকারের প্রবল প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বিরোধিতার পরেও প্রয়াত ভুট্টোর কন্যা বেনজির জিতে প্রধানমন্ত্রী হন।

জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পর পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট তার আইনসভা ও সরকার বরখাস্ত করা, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না দেওয়া, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা না করা ইত্যাদিকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে। তবে, বেশ কিছু কারণ দেখিয়ে ভেঙে দেওয়া আইনসভা ও সরকারকে পুনর্বহাল করতেও অস্বীকৃতি জানায়। এই রায়ের মাধ্যমেই জিয়ার খেয়ালখুশির ১ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিচারিক পর্যালোচনার ভেতর দিয়ে সেখানে তত্তাবধায়ক সরকার কাঠামোর একটি প্রাথমিক রূপরেখা দাঁড়িয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক প্রথার ভিত্তিতেই এমন সরকার গঠিত হয়ে আসছিল।

২০০৬ সালে এককালের যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ এবং শেষে ক্ষমতাচ্যুত ও নির্বাসিত প্রধানমন্ত্রী বেনজির আর নেওয়াজ দেশে সেনাশাসনের অবসান 
ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লন্ডনে এক ‘চার্টার অব ডেমোক্রেসি’ তে স্বাক্ষর করে সংবিধান পুনরুদ্ধারসহ রাষ্ট্র সংস্কারের যে রূপরেখা 
হাজির করেন তাতে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠাতেও একমত হন।

 ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রপ্রধান গোলাম ইসহাক খান কথিত দুর্নীতির অভিযোগে বেনজির সরকারকে বরখাস্ত করলে ১ম তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী গুলাম মুস্তাফা জাতোইয়ের নেতৃত্বে গঠিত হয় ২য় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা অবশ্য ভুল করে আমাদের মতো সরকারপ্রধানকে ‘প্রধান উপদেষ্টা’ নামে আখ্যায়িত না করে ‘তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবেই নামকরণ করে। নির্বাহী ক্ষমতা যিনি প্রয়োগ করেন তিনি উপদেষ্টা হন না।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো— তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে আবারো গুরুতর ব্যত্যয় ঘটে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দ্বারা সরকার গঠনের আপ্তবাক্যের। কারণ, নবনিযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ভেঙে দেওয়া আইনসভারই বিরোধীদলীয় নেতা এবং মন্ত্রীগণও ছিলেন বেনজিরের বিরোধীদলের রাজনীতিকগণ। সরকার প্রায় খোলাখুলিভাবেই বেনজিরের দলের বিরোধিতা করতে থাকে এবং নির্বাচনে বিরোধী নেওয়াজ শরিফ জিতে যান।

১৯৯৩ সালে এসে গোলাম ইসহাক খান নেওয়াজ সরকারকেও বরখাস্ত করলে নেওয়াজবিরোধী শিবিরের মির বালাখ শের মাজারি হন নতুন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী, অন্যদের মধ্যে মন্ত্রী হন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেনজিরের স্বামী আসিফ আলী জারদারিও (বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান)। কিন্তু নেওয়াজ হার না মেনে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে আদালত বরখাস্তের আদেশ বাতিল করে সরকার ও আইনসভা পুনর্বহাল করে। নেওয়াজ ক্ষমতায় ফিরলেও গোলাম ইসহাক খানের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করার এক পর্যায়ে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে উভয়েই পদত্যাগ করেন এবং মইন আহমদ কুরেশির নেতৃত্বে গঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

প্রায় একই ধরনের দলীয় পক্ষপাতমূলক প্রক্রিয়ায় ১৯৯৬ সালে মালিক মেরাজ খালিদ ও ২০০৭ সালে ফৌজি শাসক পারভেজ মুশাররফের আমলে মুহাম্মদ মিয়াঁ সুমরো’র নেতৃত্বে গঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তার আগে ২০০৬ সালে এককালের যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ এবং শেষে ক্ষমতাচ্যুত ও নির্বাসিত প্রধানমন্ত্রী বেনজির আর নেওয়াজ দেশে সেনাশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লন্ডনে এক ‘চার্টার অব ডেমোক্রেসি’ তে স্বাক্ষর করে সংবিধান পুনরুদ্ধারসহ রাষ্ট্র সংস্কারের যে রূপরেখা হাজির করেন তাতে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠাতেও একমত হন। বোমা বিস্ফোরণে বেনজির ভুট্টোর করুণ মৃত্যুর ভেতর দিয়ে ওঠা গণজোয়ারে এ জোট ২০০৮-এর নির্বাচনে জেতার পর ২০১০ সালে ১৮০০ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সে দেশের সংবিধানে পাকাপাকিভাবেই অন্তর্ভুক্ত করে। এরপর এ ব্যবস্থার আরো সংস্কার করা হয় ২০১২ সালের ২০তম সংবিধান সংশোধনী দিয়ে।

২০১৩ সালে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি নির্বাচিত সরকার মেয়াদ শেষ করতে সক্ষম হয় এবং এ সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় প্রথমবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। মির হাজার খান খোসো তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তার সরকারের কার্যাবলী নিয়ে উচ্চ আদালতে মোকদ্দমা দায়ের হলে সুপ্রিম কোর্ট খাজা মুহাম্মদ আসিফ মামলার রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলীর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা করে কিছু সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এরপর, বিরোধীদলগুলোর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সে দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থায় আমূল বদলের লক্ষ্যে ‘নির্বাচন আইন, ২০১৭’ পাস হয়। ২০২৩ সালে এ আইনে আরো কিছু সংশোধন-সংযোজন করা হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক কাঠামো


বর্তমান সংবিধানের ৪৮(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধান যদি জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেন, তাহলে ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন এবং ২২৪ বা ২২৪-ক অনুচ্ছেদ অনুসারে একটি তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রিসভা গঠন করবেন।

যদি মেয়াদ শেষের কারণে জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে যায়, তাহলে ৬০ দিনের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে এবং এর ১৪ দিনের মধ্যে ফলাফল ঘোষণা করতে হবে। যেকোনো কারণে জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে গেলেই রাষ্ট্রপ্রধান/গভর্নর একটি তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। রাষ্ট্রপ্রধান ভেঙে যাওয়া সর্বশেষ জাতীয় পরিষদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে পরামর্শক্রমে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আর প্রদেশের ক্ষেত্রে গভর্নর মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে পরামর্শক্রমে তত্ত্বাবধায়ক মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ করবেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শক্রমেই স্ব-স্ব মন্ত্রিসভার সদস্যরা নিযুক্ত হবেন। প্রধানমন্ত্রী/মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা জাতীয়/প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে যাওয়ার ৩ দিনের মধ্যে কাউকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী/মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করতে একমত না হলে, উভয়েই ২ জনের নাম একটি সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠাবেন। জাতীয় পরিষদের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার মনোনীত মোট ৮ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার মনোনীত মোট ৬ জন আইনপ্রণেতা নিয়ে এ কমিটি গঠিত হবে।

এক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী শিবিরের আসনসংখ্যা যাই হোক না কেনো, উভয় পক্ষ থেকে সমহারে সদস্য নিয়েই এ কমিটি গড়তে হবে। যে ক্ষেত্রে জাতীয়/প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা যথাক্রমে ৫/৪ এর কম হবে, সেক্ষেত্রে তারা সবাই কমিটির সদস্য হবেন। এ কমিটি মনোনয়ন পাওয়ার ৩ দিনের মধ্যে নাম চূড়ান্ত করবে। না হলে, তা নির্বাচন কমিশনের কাছে চলে যাবে। কমিশন ২ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী/মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করবে। এভাবে নিযুক্ত অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী/মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীগণ, তাদের স্বামী/স্ত্রী ও সন্তানেরা সংশ্লিষ্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্য হবেন না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এখতিয়ার ও ক্ষমতা

২০১০ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযোজিত হলেও এ সরকারের এখতিয়ার ও ক্ষমতা নির্ধারিত ছিল না। তখন প্রাগুক্ত খাজা মুহাম্মদ আসিফ মামলায় আদালত সিদ্ধান্ত দেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা সীমিত এবং নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই। এ সরকারের ক্ষমতার কোনো পরিধি চিহ্নিত না থাকায় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করাও আবশ্যক বলে মনে করেন তারা।
পরবর্তীতে এ বিষয়গুলো রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ও নাগরিক সমাজের দাবি হিসেবে উঠে আসার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে পাস হয় নির্বাচনি আইন। এ আইনের ২৩০ ধারায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলী নির্ধারণ করে দিয়ে কিছু করণীয় ও কিছু বর্জনীয় নির্দেশ করে দেওয়া হয়, যা এভাবে করতে পারবে—


১. নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা;
২. সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন প্রশাসনিক বিষয় সম্পাদন করা;
৩. জনস্বার্থে আবশ্যক কিন্তু যে কাজগুলো আবার নির্বাচিত সরকার এসে পালটে দিতে পারে, এমন দৈনন্দিন কার্যক্রমে নিজেদের কার্যাবলী সীমিত রাখা;
৪. সব ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক দলের প্রতি নিরপেক্ষ থাকা।
যা করতে পারবে না—
৫. বড় নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ;
৬. ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের কর্তৃত্ব লঙ্ঘন করতে পারে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ;
৭. জনস্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পাদন;
৮. ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া বিদেশি রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক আলোচনায় অংশগ্রহণ বা আন্তর্জাতিক বাধ্যতামূলক চুক্তি অনুমোদন করা;
৯. সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বা গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ দেওয়া, যদিও ভারপ্রাপ্ত বা স্বল্পমেয়াদি নিয়োগ জনস্বার্থে করা যেতে পারে;
১০. প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা না করে এবং কমিশনের অনুমোদন না নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের বদলি করা;
১১. নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা অথবা এমন কোনো কার্যকলাপে জড়িত হওয়া যা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে।

পরবর্তীতে অবশ্য ২০২৩ সালে এ বিধানে কিছুটা সংশোধনী এনে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক চুক্তি বা কিছু আইনের অধীনে ইতোমধ্যেই শুরু হওয়া মূলতঃ আর্থিক প্রকল্পগুলোর বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আবশ্যকতা দেখা দেয়, তখন এসব করণীয়/বর্জনীয় প্রযোজ্য হবে না, মর্মে বিধান করা হয়।

শেষকথা : অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল গণতন্ত্র, মতাদর্শ ও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত দেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনের জন্য তা একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হওয়া আবশ্যক— এ নৈতিক অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। সময়ে সময়ে এর নিরপেক্ষতা নিয়ে ঘোরতর বিতর্ক ও সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও সে দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল এ ব্যবস্থা অব্যাহত রেখেছে।

সব রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই সমস্যা থাকে। নিশ্ছিদ্র কোনো শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হয় না, হতে পারে না। প্রক্রিয়ায় সমস্যা হলেই বা গলদ দেখা গেলেই তারা মাথাব্যথার নিদান হিসেবে মাথাটাই কেটে ফেলেনি কখনো। ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে এ ব্যবস্থায় ক্রমাগত সাংবিধানিক ও আইনগত সংস্কার আনতে সচেষ্ট থেকেছে এবং এর সুফলও পেয়েছে কমবেশি। যার ব্যত্যয় হতে দেখা গেছে আমাদের দেশে। সর্বসম্মতভাবে গৃহীত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রক্রিয়াগত ত্রুটি সারিয়ে একে কার্যোপযোগী করে তোলার বদলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার গোপন বাসনা চরিতার্থ করার জন্য জনইচ্ছার পুরোপুরি বিরুদ্ধে গিয়ে, অনেকটাই গায়ের জোরে এই ব্যবস্থাকে বাতিল করে দেওয়ার ফল হাড়ে হাড়ে ভুগেছে বাংলাদেশের জনগণ। তাই, একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া আমাদের কর্তব্যও বটে।


লেখক : বিচারক এবং সংবিধান ও আইন বিষয়ে লেখক ও গবেষক

কেকে/এএম
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

অভিনেতা সিদ্দিককে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ, ভিডিও ভাইরাল
নবীনগরে সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত ২
পরীক্ষাকেন্দ্রে দ্বায়িত্বে অবহেলার দায়ে ৮ শিক্ষককে বহিস্কার
মোহাম্মদপুরে গলায় অস্ত্র ঠেকিয়ে কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, গ্রেফতার ৪
পুনরায় নির্বাচিত হলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মাহমুদুর রহমান

সর্বাধিক পঠিত

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ
বিজিবির পা ধরে ক্ষমা চাইলো বিএসএফ
জামিন নামঞ্জুর করে শাহরিন তুহিনকে কারাগারে প্রেরণ
কোম্পানীগঞ্জে বড় ভাইয়ের হাতে ছোট ভাই খুন
আমি এনসিপির সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত নই: উমামা ফাতেমা

মুক্তমত- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2024 Kholakagoj
🔝
close