# জুন মাসে চালু হচ্ছে পানি সরবরাহ
# ১৫০ কোটি টাকার প্রকল্প
# প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে কয়েক দফা
# হাজারো নলকূপ অকেজো
# পানির স্তর প্রতি বছর ১০ থেকে ১১ ফুট হারে নিচে নামছে
কক্সবাজারের দেড়শ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি শোধনাগার নিয়ে বিগত দিনে নয়ছয় হলেও এবার আশার বাণী শুনিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক গোলাম মুক্তাদির। আগামী জুন মাসের মধ্যে পানির লাইন ঘরে ঘরে পৌছে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। প্রথমে হোটেলমোটেল জোনকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের পানির লাইন ক্লিয়ার করে, এরপর কক্সবাজার পৌরসভার প্রতিটি ওয়ার্ড়ে কাজ শেষ করার কথা বলেছেন। সবমিলিয়ে আগামী জুনের মধ্যে কক্সবাজারবাসী সুপেয় পানির লাইন প্রতিটি ঘরে পৌঁছে যাবে এমনটা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে পানির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ঘরের জন্য এক হাজার লিটার এর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ টাকা আর হোটেল-মোটেল জোনে বাণিজ্যিকভাবে যারা ব্যবহার করবে তাদের জন্য প্রতি একহাজার লিটার এর মূল্য ৪০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এদিকে শুরুতে এই প্রকল্প নিয়ে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে বেশ তুলকালাম কান্ড হলেও বর্তমানে আলোর মুখ দেখছে প্রকল্পটি। আগামী জুন মাসের মধ্যে এই প্রকল্পের সুবিধা পাবে পর্যটন নগরীর হাজারো মানুষ।
এদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। জেলা শহরসহ উপজেলার ২ ইউনিয়নের সিংহভাগ এলাকাতেই ক্রমে নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। বিশেষ করে কক্সবাজার শহর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ও উখিয়া টেকনাফের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। জেলার সরকারি প্রায় ৩১ হাজার নলকুপের মধ্যে প্রায় ৭ হাজার অকেজো হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। পানি উঠছে না আরো অন্তত কয়েক হাজার নলকূপে। উপকূল-সমতল, উঁচু নিচু পাহাড়ি জনপদ সংকট একই ধরনের। ভোগান্তি বেড়েছে উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্পেও।
কক্সবাজার শহর ও সমুদ্রতীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নামছে। ইতোমধ্যে শহরের সাগর-তীরবর্তী এলাকার হাজার হাজার অগভীর নলকূপ বিকল হয়ে গেছে। কিছু এলাকার গভীর-অগভীর নলকুপগুলো থেকে উঠে আসছে পানের অযোগ্য লবণাক্ত পানি। ফলে গুরুতর পানি সংকটে পড়েছেন শহরের ৫ লক্ষাধিক বাসিন্দা। সংকট নিরসনে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা ব্যয়ে শহরের ঝিলংজা মৌজায় ২০২০ সালে ‘ভূ-উপরস্থ পানি শোধনাগার’ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করে সরকার। দুই দফা প্রকল্পের সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালে শোধনাগারের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা থাকলেও আবারো মেয়াদ বাড়িয়ে এই বছরের জুন মাস পর্যন্ত করা হয়েছে। এদিকে জুনের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে না পারলে ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে। প্রথমে প্রতিটি ঘরের পানির লাইন পৌরসভার করার কথা থাকলেও পরবর্তীতে প্রকল্পের অধিনে করতে অফিসিয়াল নানান জটিলতার কারণে শুরু হয়নি বসতবাড়ির সরবরাহ লাইন স্থাপনের কাজও। তবে শিগগিরই লাইনের কাজ শেষ করবে বলে জানেিয়ছেন প্রকল্প কর্মকর্তা। এদিকে দেরি হওয়ার কারণে প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
কক্সবাজারের পানি সংকট দূর করতে সুপেয় পানি সংকট দূর করতে কক্সবাজার শহরে ভূ-উপরস্থ পানি শোধনাগার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। সদর উপজেলার ঝিলংজা মৌজায় ২.১৭৫০ একর জমি অধিহণ করে ২০২৪ সালে শোধনাগার নির্মাণ শেষ করার কথা ছিল। শহরের গোলদিঘিপাড় এলাকায় পাহাড়ে একটি মাদার ট্যাঙ্কসহ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়ামসংলগ্ন এলাকা, দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়া, সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট এবং বাস টার্মিনাল এলাকায় তৈরি করা হয়েছে পাঁচটি ওভার ট্যাঙ্ক বা উচ্চ জলাধার। এখনো বসতবাড়ির সরবরাহ লাইনের কাজ শুরু করা হয়নি, তবে জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পের পূর্ণ মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ২০২৪ সালের জুন পযর্ন্ত সময় বাড়ানো হয়। তারপরও সরবরাহ লাইনের কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় বারের মতো ২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয় মেয়াদ।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি ঘণ্টায় ১০ লাখ লিটার (এক হাজার মিটার কিউব) পানি পরিশোধন করা হবে শোধনাগারে। সেখান থেকে পৌরসভার ১ লাখ ২০ হাজার মানুষকে পানি সরবরাহ করা হবে। সরবরাহ লাইন না বসানোয় এখনো শোধনাগারটি চালু করা যায়নি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ইবনে মায়াজ প্রামাণিক জানান, পানি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ। শুরুতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেরি হওয়ায় সরবরাহ লাইনের কাজ শুরু করতে একটু দেরি হয়েছে। এই বছরের জুন পর্যন্ত সময় থাকলেও সময় বাড়িয়ে আশা করছি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হবে এবং ঘরে ঘরে পানি সরবরাহ করতে পারবো।
প্রকল্প পরিচালক গোলাম মুক্তাদির জানান, আমরা যখন প্রকল্পটি হাতে নিই। তখন হাউসহোল্ড কানেকশন ধরাই ছিল না। কারণ হাউসহোল্ড কানেকশনটা পৌরসভা দেওয়ার কথা ছিল। পরে পৌরসভা অপারগতা প্রকাশ করলে কাজটা পিছিয়ে যায়। এখন এ প্যাকেজটি নতুন করে প্রকল্পের ভেতরে আনা হয়েছে। যদিও দেরি হয়েছে, তারপরও প্রকল্পটি রিভিশন করে হাউস কানেকশন ইনক্লুড করে মন্ত্রণালয় থেকে পাস করিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কক্সবাজার শহরে পাঁচ শতাধিক হোটেল-গেস্ট হাউসে অপরিকল্পিত গভীর নলকূপে পানি উত্তোলন বাড়ছে। পাশাপাশি ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর ভূগর্ভস্থ অতিরিক্ত পানি উত্তোলনও বেড়েছে। এতে কক্সবাজারে দিন দিন পানির স্তর নিচে নামছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানি সংকটের পাশাপাশি পানিতে বাড়ছে লবণাক্ততার মাত্রাও।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কক্সবাজার শহরে প্রায় ৩ হাজার গভীর নলকূপ ও ৩০ হাজার অগভীর নলকূপ দিয়ে দৈনিক ৩ কোটি লিটার পানি তোলা হচ্ছে। শহরের ২ লাখ বাসিন্দা ছাড়াও প্রায় এক লাখ পর্যটকের চাহিদা মেটায় এ নলকূপগুলো। নলকূপ-গুলোতে বর্ষাকালে অর্থাৎ মে মাসের শেষ দিক থেকে নভেম্বরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত স্বাভাবিক পানি থাকলেও বাকি সময় বিপত্তি ঘটে। এ সময় নলকূপ থেকে উচ্চমাত্রায় লবণাক্ত পানি উঠে আসে অথবা নলকূপ বিকল হয়ে যায়।
এদিকে কক্সবাজার শহর ছাড়াও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন রোহিঙ্গারা জনপ্রতি ১০ লিটার করে পানি পাচ্ছেন। এই পরিমাণ পানি জীবনধারণের প্রয়োজনের অর্ধেক। মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) বা সীমান্তবিহীন চিকিৎসক দল বলেছে, পানি সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা হুমকির মুখে পড়েছে। এমএসএফ জরুরি ভিত্তিতে সংকট নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
জানা গেছে, কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণত মাটির নিচে ৩০-৩৫ ফুট গভীরে পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু কিছু এলাকায় পানির স্তর ৯০ থেকে ১৬০ ফুটে নেমে গেছে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে ওইসব এলাকায় পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলোও ক্রমেই শূন্য হয়ে পড়ে। এতে গৃহস্থালি কাজে অচলাবস্থা দেখা দেয়। বোরো মৌসুমে পানির সংকটের আশঙ্কা থাকেন কৃষকেরা।
ভুক্তভোগীরা জানান, গ্রীষ্মে এবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ টিউবওয়েল থেকে পানি উঠছে না। শহরে পানি কিনে পানের সুযোগ থাকলেও গ্রামে সুপেয় পানির জন্য নলকূপই ভরসা। গ্রামের অনেকেই পানযোগ্য এক কলসি পানি আনতে অনেকদূর যেতে হচ্ছে। তারপরই মিলছে পানি। আর যারা দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিতে পারছেন না, তাদের টাকার বিনিময়ে কিনতে হচ্ছে খাওয়ার পানি।
কক্সবাজার পৌরসভা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের মতে, কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। কক্সবাজারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ১০ থেকে ১১ ফুট হারে নিচে নামছে। ১০ বছর আগেও শহরের টেকপাড়ায় ১২০ থেকে ১৫০ ফুটের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পাওয়া যেত। অথচ এখন পানির জন্য যেতে হয় ৩০০ থেকে ৫০০ ফুটের বেশি গভীরে। গত কয়েক বছরে কক্সবাজার সাগরপাড়ের কলাতলী এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১০ থেকে ১৫ ফুট নিচে নেমেছে। ফলে অকেজো হয়েছে সাগরপাড়ের তিন শতাধিক আবাসিক হোটেলের অসংখ্য পানির পাম্প। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এমন অবস্থা বলে মনে করছে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর। কলেজগেট, পালাকাটা, নতুনমহাল, পোকখালী, গোমাতলী, জালালাবাদ, ইসলামপুর, ইসলামাবাদসহ টেকনাফ, উখিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, মহেশখালী, রামু ও কুতুবদিয়ার বিভিন্ন এলাকায়।
কক্সবাজার জেলা বাপার সভাপতি এইচএম এরশাদ জানান, অপরিকল্পিত নগরায়ণে খোলা জায়গা ও জলাধার কমে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, দেশে ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পুকুর- লেক বা নদীর পানির ব্যবহার বৃদ্ধি করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হাবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি তোলা এবং যত্রতত্রভাবে পুকুর-খাল-বিল ভরাটের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সামনে বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটিজ ফোরমের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন জানান, বন, পাহাড়প্রকৃতি, নদী, খাল, ছড়া, জলাশয় ও প্রাকৃতিক জলাধারসমূহ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে সুপেয় পানি আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।
কেকে/এজে