গত বছরের জুলাই মাসে দেশের রাজপথে লাখো মানুষ নামেন পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে। তাদের দাবি ছিল দুর্নীতি বন্ধ হোক, বৈষম্যের অবসান হোক, আর সবার জন্য একটা ন্যায্য সমাজ গড়ে উঠুক। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। কিন্তু মাত্র ৯ মাসের মধ্যেই সেই আশার আলো যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা পরিষদের একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে উঠেছে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। সম্প্রতি তিনজন উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের হঠাৎ করে অপসারণ করা হয়েছে, যা প্রশাসনিক মহলে গোপন অনিয়মের বড় ইঙ্গিত বলেই বিবেচিত হচ্ছে। সূত্র বলছে, এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে, যা উপদেষ্টাদের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তোলে।
গত ২১ এপ্রিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মোয়াজ্জেম হোসেন এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তুহিন ফারাবিকে অব্যাহতি দিয়ে সরকারি আদেশ জারি হয়। অপরদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের একান্ত সচিব (পিএস) মুহাম্মদ হাসনাত মোর্শেদ ভূঁইয়াকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত ৬ এপ্রিল তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তবে বিষয়টি জানাজানি হয় ২৮ এপ্রিল।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সাবেক এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন। অভিযোগ উঠেছে, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগ ও বদলিবাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্য এবং ফ্যাসিবাদের দোসর প্রকৌশলীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে শতকোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ঘুরে ঘুরে তদবির করতেন। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র, পানিসম্পদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগে ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার তদবির করতেন। এমনকি পুলিশের জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ, শটগানসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনায় ঠিকাদারদের বিল পাইয়ে দিতে তদবিরও করেছেন মোয়াজ্জেম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বিগত সরকারের সময় কাজ পাওয়া যেসব ঠিকাদার পালিয়েছেন তাদের কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন নিয়োগ দেওয়া ঠিকাদারদের থেকে বড় অংকের কমিশন হাতিয়েছেন তিনি। গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঠিকাদার ও প্রকৌশলী বদলির তদবির করতেন তিনি। ঢাকা মহানগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভাগীয় শহর, ঢাকার নিকটবর্তী জেলাগুলোয় প্রকৌশলী বদলির একেকটিতে লাখ লাখ টাকা দিতে হতো তাকে।
এ ছাড়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন পৌরসভার সচিব ও প্রকৌশলী, সিটি করপোরেশনে বিভিন্ন গ্রেডের কর্মকর্তা নিয়োগে বদলিবাণিজ্য করতেন। শুধু তাই নয়, ফ্যাসিবাদের দোসর হিসাবে চিহ্নিত প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে তাদের পুনর্বাসনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন মোয়াজ্জেম-এমন অভিযোগ খোদ স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তাদের।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ব্যক্তিগত দুই কর্মকর্তা (ছাত্র প্রতিনিধি) তুহিন ফারাবি ও মো. মাহমুদ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা চিকিৎসক, মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল, পরিচালক, উপপরিচালক, সিভিল সার্জন নিয়োগ-বদলির মাধ্যমে শতকোটি টাকা হাতিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দুজন মিলে মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল, পরিচালক, উপপরিচালক, সিভিল সার্জন নিয়োগ-বদলিতে ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা আদায় করতেন। এরপর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে বিপুলসংখ্যক চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলি করেন তারা। এ ছাড়া সিনিয়র স্টাফ নার্স ও মিডওয়াইফ বদলিতে তারা দুই লাখ টাকা করে আদায় করতেন। এমনকি হজ টিমে নার্স ও ডাক্তারদের নাম ঢুকানোর জন্য টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, ৮ আগস্টের পর সাবেক স্বাস্থ্য সচিবকে দিয়ে বেশ কিছু চিকিৎসক বদলি করান তুহিন ফারাবী ও ডা. মাহমুদুল হাসান। প্রতিটি বদলিতে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ইতোমধ্যেই মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং তুহিন ফারাবির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত বৃহস্পতিবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন এ তথ্য জানান।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, তাদের আবার নানাভাবে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে একাধিক প্রভাবশালী উপদেষ্টা কৌশলে আওয়ামীপন্থি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পুনর্বহাল করছেন এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের প্রভাব বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে জুলাই বিপ্লব কি কেবল একটি প্রতীকী ঘটনা হয়ে থাকবে?
এদিকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সারা দেশে দখল ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশাসনিক কাজেও হস্তক্ষেপ করছে তারা। ব্যক্তি স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজেদের ভেতর মারামারির ঘটনাও এখন প্রকাশ্যে। ফলে বৈষম্যবিরোধীরাই এখন নানা ভাগে বিভক্ত। ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে একাধিক সংগঠনও। নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ এনসিপি। আবু বাকের মজুমদারের নেতৃত্বে ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ (বাগছাস)। আর উমামা ফাতেমা নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুরোনো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। যদিও নাহিদ ইসলামসহ একাধিক নেতা বলেছেন এনসিপি গঠনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সেটার আর অস্তিত্ব নেই। তবে তাদের সে কথা মানতে নারাজ আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা। এর মাধ্যমে যারা এই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখসারির নেতৃত্বে ছিলেন তারা জুলাই স্পিরিট ভুলে নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ আর দলাদলিতে ব্যস্ত।
সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ভারতের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ উঠেছে। তারা নিয়মিতভাবে ভারতীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগ তুলেছেন রাজনৈতিক এক্টিভিস্টরা। এ ছাড়া তারা কৌশলে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যদিও এসব অভিযোগের কোনোটিই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রমাণ হয়নি, তবে বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক।
প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়েও অসন্তুষ্ট অনেকেই। জনগণের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে এই অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার মূল দায় কি প্রধান উপদেষ্টার? কেন তিনি এসব রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না? অনেকেই বলছেন, তার নেতৃত্ব দুর্বল এবং সিদ্ধান্তহীনতায় ভরা, যার ফলে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে উঠছে প্রশ্ন নতুন বাংলাদেশ গড়ার নামে কি পুরনো শক্তিরই পুনঃপ্রতিষ্ঠা হচ্ছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা আন্দোলন করেছিল, তাদের স্বপ্নের সঙ্গে এখনকার বাস্তবতার মিল নেই। এভাবে চলতে থাকলে জনগণের আস্থা আর থাকবে না। উপদেষ্টারা যদি সৎ না হন, তাহলে পুরো বিপ্লবটাই বৃথা যাবে। তখন শুধু এই সরকারই নয়, ভবিষ্যতের জন্যও বিপদ তৈরি হবে। আমরা যদি এখনই হিসাব-নিকাশ না করি, তাহলে এই ব্যর্থতা ইতিহাসের দায় হয়ে থাকবে।
কেকে/ এমএস