বাংলাদেশ রেলওয়েতে বর্তমানে বড় সংকট হয়ে উঠেছে অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তার অভাব। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য পড়ে রয়েছে, আবার যেসব কর্মকর্তা দায়িত্বে আছেন, তাদের অনেকেই অস্থায়ী বা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। এতে করে রেলওয়ের পরিকল্পনা, পরিচালনা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে, যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে পুরো দেশের রেলসেবার ওপর।
রেলওয়ের পরিবহন সেবা সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের নানা পরিকল্পনা থাকলেও তা বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে লোকবল সংকট। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন শূন্যপদ পূরণ না হওয়ায় সময়মতো ট্রেন পরিচালনা, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও যাত্রীসেবা ব্যাহত হচ্ছে। এতে শুধু যাত্রী দুর্ভোগই বাড়ছে না, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবিলম্বে রেলওয়ের শূন্য পদগুলো দ্রুত পূরণ করতে হবে। একইসঙ্গে কর্মীদের আধুনিক প্রশিক্ষণ, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গতি এবং প্রযুক্তিনির্ভর পরিচালনার ওপর জোর দিতে হবে। রেলওয়ের কার্যক্রমকে স্বয়ংক্রিয় ও দক্ষ করতে একটি পৃথক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ কমিশন গঠন এবং রেলওয়ের প্রশাসনিক স্বাধীনতা বাড়ানোর দাবিও উঠেছে। রেলের প্রযুক্তি ও অবকাঠামো যতই হালনাগাদ করা হোক, যদি সঠিক নেতৃত্ব ও দক্ষ কর্মকর্তা না থাকে, তবে উন্নয়ন থেমে যাবে। নেতৃত্ব সংকটই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
রেলওয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, প্রতিনিয়ত ট্রেনের সংখ্যা ও রুট বাড়ছে। এজন্য আগের জনবল কাঠামো সংশোধনের প্রয়োজন হচ্ছে। তবে যেভাবে ট্রেনের সংখ্যা ও রুট বেড়েছে সে হারে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। জনবল কাঠামো সংশোধন করে নিয়োগ কার্যক্রম চলছে এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কিছু জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে জনবল সংকট এখনো প্রকট। রেলওয়ের অনেককে একাধিক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। তবে সব পদে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয়। কিছু পদ আছে যেগুলো শুধু পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণযোগ্য। সেখানে যদি যোগ্য কর্মকর্তা না থাকে, তাহলে পদটি শূন্যই থেকে যায়।
রেলওয়েতে প্রাথমিক নিয়োগপদ সাধারণত ১৯তম ও ২০তম গ্রেডে হয়। এর ওপরের পদগুলোতে সরাসরি নিয়োগের সুযোগ না থাকায় পদোন্নতির মাধ্যমেই সেই শূন্যতা পূরণ করতে হয়। ফলে যেখানে যোগ্য জনবল নেই, সেখানে পদোন্নতি সম্ভব নয় এবং পদগুলো শূন্য থেকেই যায়। এ জটিলতা দূর করা কঠিন, কারণ যোগ্য লোক পেলেই কেবল নিয়োগ দেওয়া সম্ভব।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম জনবল সংকটের বাস্তবতা তুলে ধরে বলেন, ‘বর্তমানে রেলওয়ের মোট অনুমোদিত জনবল ৪৩ হাজার হলেও কর্মরত রয়েছেন মাত্র ২৬ হাজার। ফলে সব ক্ষেত্রেই আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে ট্রেন পরিচালনায় যে স্মুথনেস থাকা উচিত, তা ব্যাহত হচ্ছে। অপারেশনাল কার্যক্রমে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ অবস্থার উন্নয়নে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।’
রেলওয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্তকর্তা জানান, বর্তমানে অনুমোদিত পদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ পদ শূন্য রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংকট রয়েছে ট্রেনচালক, সহকারী চালক, গার্ড, স্টেশন মাস্টার, টিকিট পরীক্ষক, সিগন্যাল কর্মী, ট্র্যাকম্যান ও প্রকৌশল বিভাগে। ফলে সীমিত জনবল দিয়ে পুরো রেলব্যবস্থা চালাতে গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে পরিচালন কাঠামো।
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘রেলওয়েতে জনবল সংকট এতটাই তীব্র যে, অনেক কর্মীকে নিয়মিতভাবে ডাবল ডিউটি করতে হচ্ছে। বর্তমানে প্রয়োজনীয় জনবলের অর্ধেকও কর্মরত নেই। যেখানে তিনজন থাকার কথা, সেখানে একজন কাজ করছেন; আবার পাঁচজনের স্থানে কাজ করছেন মাত্র দুজন। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ছে এবং নিরাপদ ও সঠিকভাবে ট্রেন পরিচালনা বিঘ্নিত হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পরিচালন পর্যায়েও জনবল ঘাটতি আছে, তবে নিচের স্তরে জনবল নিয়োগ সবচেয়ে বেশি জরুরি, কারণ তারাই মূল অপারেশনাল কার্যক্রমে যুক্ত। কিন্তু নিয়োগবিধি সংশ্লিষ্ট জটিলতা এবং একাধিক মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে সময়মতো নিয়োগ ও পদোন্নতি সম্ভব হচ্ছে না।’
মজিবুর রহমান বলেন, ‘রেলওয়ের ওপর দীর্ঘদিন ধরে অব্যবস্থাপনার ছাপ স্পষ্ট। কোনো সরকারই রেলওয়েতে সুপরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগ করেনি। বরং সব সরকারই অপরিকল্পিত খরচ করেছে, যার ফলে সম্ভাবনাময় এ খাত ক্রমাগত ক্ষতির মুখে পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রেলওয়ের যে পরিমাণ সম্পদ ও অবকাঠামো রয়েছে, তা সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যবহার করা হলে রেলকে একটি লাভজনক খাতে রূপান্তর করা সম্ভব। অথচ বারবার রেল কর্তৃপক্ষের ওপর দায় চাপানো হয় বলা হয় আড়াই টাকা খরচ করে এক টাকা আয় হয়। অথচ এর পেছনের মূল কারণ অব্যবস্থাপনা ও দুর্বল পরিকল্পনা।’
নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে : ট্রেনচালক ও সহকারী চালকের সংকটের কারণে অনেক সময় এক চালককে টানা ১২-১৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। এতে করে ট্রেন দুর্ঘটনার ঝুঁকি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্লান্তি ও মনোযোগে ঘাটতির কারণে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে যায়। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার পেছনে দীর্ঘসময় কাজ করা চালকদের শারীরিক ও মানসিক চাপ দায়ী ছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে।
সেবা ব্যাহত, যাত্রীরা ভোগান্তিতে : টিকিট কাটতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো, নির্ধারিত সময়ে ট্রেন না পাওয়া, স্টেশনে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকা, হেল্পডেস্কে কর্মী না পাওয়া এসব সমস্যার অন্যতম কারণ হলো লোকবল সংকট। অভিযোগ আছে, অনেক স্টেশনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কর্মী না থাকায় যাত্রীরা চুরি ও হয়রানির শিকার হন। মালবাহী ট্রেন ব্যবস্থাপনায়ও একই অবস্থা। পর্যাপ্ত গার্ড না থাকায় মাল পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে। এতে শিল্প খাত ও রফতানি বাণিজ্যেও প্রভাব পড়ছে।
পুরোনো জনবল, প্রশিক্ষণের ঘাটতি : বর্তমানে রেলওয়ের অনেক কর্মীই অবসরের কাছাকাছি। নতুন নিয়োগ দীর্ঘসূত্রতায় আটকে থাকায় অভিজ্ঞতার সঞ্চালনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের অভাবও প্রকট। বাংলাদেশ রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সেবা দিতে চাই, কিন্তু প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকবল না থাকায় সেখানে পৌঁছাতে পারছি না।’
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জটিলতা : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক ছাড়, পিএসসি বা রেলওয়ে নিজস্ব নিয়োগ প্রক্রিয়া সব মিলিয়ে একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগে প্রায় ১-২ বছর। ততদিনে নতুন চাহিদা তৈরি হয়, আর আগের তালিকা পুরোনো হয়ে যায়।
পদোন্নতিতে জটিলতা : রেলওয়ের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক কাঠামো অনুযায়ী, বিভিন্ন ক্যাডারে ২০ বছরেও পদোন্নতি না পাওয়ার নজির রয়েছে। সিনিয়র স্কেল, সিলেকশন গ্রেড, অতিরিক্ত সচিব পদে উন্নীত হতে সময় লাগে অনেক বেশি। এতে করে অনেক কর্মকর্তা পেশাগত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ে অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা বলেন, ‘আমরা পরিকল্পনা করলেও অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। আবার প্রশাসনিক পদে অদক্ষ বা রেলবহির্ভূত কর্মকর্তা এলে রেলওয়ের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
কেকে/ এমএস