গাজীপুরের মালেকের বাড়ি এলাকায় বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে টি অ্যান্ড জেড অ্যাপারেলস লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা টানা ২৪ ঘণ্টা ধরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছেন। এই অবরোধের ফলে টঙ্গীর আব্দুল্লাহপুর থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের হোতাপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার যাত্রী ও কর্মজীবী মানুষ এই যানজটে আটকে পড়েছেন, যারা নিজেদের দৈনন্দিন কাজে বের হয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন।
আজ রোববার (১০ নভেম্বর) দেখা যায়, শ্রমিকদের এই বিক্ষোভ শনিবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শুরু হয় এবং আজ পর্যন্ত তা চলমান রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও বেতন পরিশোধের দাবিতে একরোখা অবস্থানে থাকা শ্রমিকদের আন্দোলন বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। শ্রমিকদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া বেতন না দেওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছেন।
টি অ্যান্ড জেড অ্যাপারেলস লিমিটেডের আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানান, এই কারখানাসহ তাদের গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত আরো পাঁচটি কারখানার মোট চার মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। এপ্রিল মাসে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়, এবং গত সেপ্টেম্বরে পুনরায় চালু হলেও বেতন সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হয়নি। ফলে একদিকে বকেয়া বেতনের বোঝা এবং অন্যদিকে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা আদায়ের দাবিতে বাধ্য হয়ে আন্দোলনের পথে নেমেছেন।
আশরাফ আলী, বকুল ও সুলতান শেখ নামের আন্দোলনরত শ্রমিকরা জানান, আমরা গত চার মাস ধরে বেতন না পেয়ে পরিবার নিয়ে অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছি। কারখানা খুললেও কর্তৃপক্ষ কোনো সমাধান না দিয়ে কেবল তারিখ দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের জীবন চলছে ধার-দেনা করে। শ্রমিকদের আরও অভিযোগ, বেতন না দেওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষ নানা রকম তালবাহানা করছে। ফলে বাধ্য হয়ে আমাদের রাস্তায় নামতে হয়েছে। যদি বেতন না পাই, তাহলে সংসার চলবে কীভাবে?
এত দীর্ঘ সময় ধরে প্রধান সড়ক অবরুদ্ধ থাকায় প্রায় লাখো মানুষ ব্যাপক ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। সকাল থেকে যান চলাচল বন্ধ থাকায় ঢাকাগামী ও ময়মনসিংহগামী যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। কর্মজীবী মানুষ, শিক্ষার্থী, রোগীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকেন, যাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য হেঁটে চলেছেন।
ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী এক যাত্রী তারা মিয়া বলেন, সকাল থেকেই আমরা যানজটে আটকে আছি। খাওয়ার পানি ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সংকটে ভুগছি। পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে এই দুর্ভোগ আরও বাড়বে। এমন অনেকেই খাবার ও পানির অভাবে দিন কাটাতে বাধ্য হন, যারা দিনশেষে তাদের কাজে পৌঁছাতে পারেননি।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খলিলুর রহমান জানান, শ্রমিকদের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি না আসায় এই আন্দোলন থামানো সম্ভব হচ্ছে না।
শ্রমিকরা জানান, একাধিকবার তারা কারখানার মালিক পক্ষের কাছে তাদের বকেয়া পরিশোধের অনুরোধ করলেও কোনো প্রতিক্রিয়া মেলেনি। অনেক শ্রমিকই ভেঙে পড়েছেন এবং কারখানার আশেপাশে অবস্থান নিয়েই মহাসড়কে অবরোধ অব্যাহত রেখেছেন।
গাজীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদ মিয়া জানান, শনিবার বিকেলে বিজিএমইএ এবং কারখানা মালিকদের মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছে, যেখানে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আজ রোববার শ্রম উপদেষ্টার সাথে বিজিএমইএ, জেলা প্রশাসক এবং কারখানা মালিকদের আরেকটি বৈঠকের কথা রয়েছে। আমরা আশা করছি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ময়মনসিংহগামী বাসের চালক রাসেল, চালকের সহকারী হেকমত ও কুমোর আলী জানান, শনিবার সকাল ৭টার দিকে যাত্রী নিয়ে মহাখালী থেকে রওনা হয়ে তারা সকাল ৯টার দিকে গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় পৌঁছান। সেখানে যানজট দেখতে পেয়ে প্রথমে ভেবেছিলেন দুপুর নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু সারাদিন অপেক্ষার পরও যানজট না কমায় তারা বাসের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকেন। তাদের সঙ্গে থাকা যাত্রীদের অনেকেই বিরক্ত হয়ে বাস থেকে নেমে যান, তবে তারা বাধ্য হয়ে গাড়িতেই থেকে যান।
বাসচালক হেকমত জানান, প্রতিবার যখন কোনো দাবি নিয়ে শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করে, মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে যাত্রী এবং আমাদের মতো পরিবহনকর্মীরাও দুর্ভোগে পড়ে। এমন অবস্থায় কীভাবে কাজ করব আমরা।
চালকদের মধ্যে কুমোর আলী বলেন, আমাদের কোনো ভুল না থাকলেও আন্দোলনের সময় আমাদেরকেই ভোগান্তির শিকার হতে হয়। রাতদিন মহাসড়কে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করি, কিন্তু এই ধরনের অবস্থায় আমাদের মানসিক ও শারীরিক কষ্ট বেড়ে যায়।
এই বিক্ষোভের কারণে শুধু যাত্রী ও চালক-সহকারী নয়, পুরো পরিবহন খাতই ক্ষতির মুখে পড়ছে। ট্রাফিক পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে।
পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টরা জানান, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ে আন্দোলন একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে জনসাধারণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে শ্রমিকদের দাবি দ্রুত মেটানো হয় এবং মহাসড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখা হয়।
অনেকেই এ পরিস্থিতিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দ্রুত হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন। তারা আশা করেন, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি দ্রুত সমাধান হবে এবং মহাসড়কে এভাবে আন্দোলন চলতে থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কর্মজীবীরা মনে করেন, এমন উদ্যোগ থাকলে দেশের সার্বিক কর্মজীবন ও যাতায়াত ব্যবস্থার ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং নাগরিকদের দুর্ভোগ কমবে।
কেকে/এজে