জুলাই গণঅভ্যুত্থান অনেকগুলো বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। তার সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য ক্রমাগত উসকে দিয়েছে শুরু থেকেই। অনেকের কাছে ক্ষমতাসীনদের মেলে ধরা বয়ানই ধ্রুব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এবার সেই বয়ানের খণ্ডন আর সত্য মিথ্যার বিবেচনার দিকে এগোচ্ছি আমরা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সময় থেকে এ পর্যন্ত ব্যর্থতার কারণগুলো অনুসন্ধানে রত হয়েছি। স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রাটাই শুরু হয়েছে অনিয়মতান্ত্রিক, জনআকাঙ্ক্ষার বিপরীতে আর পুরোনো তলোয়ারকে নতুন খামে ভরার মধ্য দিয়ে। সেই ব্যর্থ যাত্রার নজরানা বাংলাদেশের মানুষকে দিতে হয়েছে বারবার। অনেক মৃত্যুর বিনিময়েও তার দায়মুক্তি ঘটেনি। দুই সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে এবার সুযোগ এসেছে।
সদ্য স্বাধীন দেশের শাসন ক্ষমতা ঐতিহাসিক কারণে গিয়ে পড়েছে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে। কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যে রাজনীতি হাজির করেছিল, যে মুক্তির বার্তা দিয়েছিল তার কোনোটাই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে রক্ষা তো করতে পারেনি, উপরন্তু গণতান্ত্রিক বিকাশের সমস্ত পথকে রুদ্ধ করেছে আইয়ুব-মোনেম খানদের মতোই। ক্রমাগত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ। কেন আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়েছিল, তার একটা ব্যাখ্যা তৎকালেই করেছিলেন বর্ষীয়ান তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বদরুদ্দীন উমর। ১৯৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক গণকণ্ঠে তিনি একটি নিবন্ধ লিখেন। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ জনগণ হতে দ্রুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এর কারণ আমাদেরকে ১৯৭১ সালের ৯ মাসব্যাপী প্রতিরোধ-সংগ্রামের মধ্যেই অন্বেষণ করতে হবে। এই অন্বেষণের ফলে আমরা দেখতে পাবো, তৎকালীন সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়েছিল, সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার কোনো ক্ষমতা বাংলাদেশে অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকার ও শাসক শ্রেণির নেই।’ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ৩৬ দিন এবং প্রায় দুই হাজার শহীদ ও হাজার হাজার হতাহতের মধ্য দিয়েও একই ধরনের গণআকাঙ্ক্ষার জাগরণ ঘটেছে। আমাদের সেই জাগরণকে সামনে রেখেই দেশকে নতুন করে সাজাতে হবে।
শেখ মুজিবের দল আওয়ামী লীগ যেমন পাকিস্তানী আমলের আইয়ুব-মোনেম-ইয়াহিয়ার শাসনকে ‘নবজীবন’ দিয়েছে। একই ধরনের ভুল আমাদের করার আর সুযোগ নেই। পুরোনো সমাজকে বদলের দাবি, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দিকে এগোতে হবে। এই যাত্রায় যুক্ত করতে হবে পুরো দেশকে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারকেই এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
নতুন যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি আমরা; সেই বাংলাদেশের ভিত্তি হবে একাত্তর ও চব্বিশের গণআকাঙ্ক্ষা। ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শুরুর যাত্রাটা আমাদের পুনর্মূল্যয়ন করা যেমন জরুরি তেমনি সকলকে যুক্ত করাও। পাকিস্তানে যে মুজিব বাঙালিদের কাছে নায়ক, বাংলাদেশে তিনি কীভাবে খলনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হলেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে তার দলটি কীভাবে বাংলাদেশে ভয়ানক ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠা করলো তার তথ্য-তালাশ ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে হবে। আওয়ামী লীগ একাই দেশ প্রেমিক আর তার হাতেই দেশ সবচেয়ে নিরাপদ এমন ভাবনাই মুজিবকে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পক্ষগুলোকে নিয়ে সরকার গঠনের দাবিকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। আমাদের সেটি মনে রাখা জরুরি।
মৌলিক অধিকারকে কাগুজে হওয়া থেকে রক্ষা, বৈষম্য নিরসন, সর্বত্র সন্ত্রাস ও মাস্তানের রাজনীতি বদলাতে হলে রাষ্ট্র মেরামতের এই সময়টাতে সবাইকেই সঙ্গে নিতে হবে। কাউকে বঞ্চিত রেখে বা কোনো অঞ্চলকে বাদ দিয়ে আমরা ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না।
দুই. জুলাই আমাদের জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছে। আমরা সেই পথে এগোচ্ছি। তবে কতদূর পৌঁছাতে পারবো, তা বলা কঠিন। সরকারের পরিসর, মাঠের রাজনীতি- আমাদের আশ্বস্ত করতে পারছে না। সম্প্রতি উপদেষ্টা পর্ষদে তিনজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর বিপরীতে দুটো বিতর্ক সামনে এসেছে। এই দুটো বিতর্ককে বিশ্লেষণ করার জরুরত রয়েছে। বিতর্ক দুটির একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে। অপরটি ভৌগোলিক বৈষম্যের শিকার হওয়ার অভিযোগ। এরমধ্যে দ্বিতীয় বিতর্কটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া দরকার।
গণতান্ত্রিক যাত্রার শুরুর দিকে প্রত্যেক দেশেই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিকাশমান সেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কীভাবে এই বিতর্কের সমাধান করেছে তার থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। লেখক সাখাওয়াত টিপু সেই কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘নগর গ্রিক রাষ্ট্রের বিকাশের সময় বর্তমান বাংলাদেশের মতো একই অবস্থা ছিল। নেতৃত্ব নির্বাচন ছিল একটা বড় সমস্যা। সংকটময় সময়ে এমন ব্যক্তিকে বা নেতৃত্বকে নির্বাচিত করা ঠিক নয়, যার জন্য বড় অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিকাশমান গ্রিসেও এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে এমন দুয়েক এক নেতৃত্ব কিছুদিন ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিতর্কের জন্য অন্য কোনো দ্বীপে নির্বাসিত হয়েছেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক গ্রিসে বিকাশমান সময়ে দেখা গেছে, যাকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তিনি স্বেচ্চায় ক্ষমতা থেকে প্রস্থান করেছেন। এটাই সহজ শিক্ষা। গণতান্ত্রিক সমাজের দিকে যাওয়ার এটাই অনন্য উপায়! জনগণের আকাঙ্ক্ষা, ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিপরীতে ভবিষ্যত গণতান্ত্রিক সমাজের দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে বাংলাদেশ। আমরা কি সেটা টের পাই?’ নিয়োগের বিতর্ক আপাতত স্তিমিত, কারণ এই বিতর্কের পেছনে মতাদর্শিক রাজনীতির স্বার্থের সংশ্রব রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। এছাড়া যে ব্যক্তিকে নিয়ে এই বিতর্ক তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্প্রিরিটকে ধারণ করেন। উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও রেখেছেন- এ কথা সত্য।
অন্য যে বিতর্ক সেটি ভৌগোলিক বৈষম্যের। গণঅভ্যুত্থানের নেতা সার্জিস আলম সেই বিতর্কের সূচনা করেছেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘শুধু একটা বিভাগ থেকে ১৩ জন উপদেষ্টা! অথচ উত্তরবঙ্গের রংপুর, রাজশাহী বিভাগের ১৬টা জেলা থেকে কোনো উপদেষ্টা নাই!’ তার এই পোস্টের পরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়; বিশেষত রংপুরে। গত ১১ নভেম্বর রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। সেখানে উত্তরবঙ্গ থেকে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আকতার হোসেনসহ কমপক্ষে ৫ জন উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানানো হয়। প্রধান উপদেষ্টা রংপুরকে দেশের এক নম্বর জেলা হিসেবে পরিণত করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন অভ্যুত্থানকারী ছাত্ররা।
অবস্থান কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, ‘বৈষম্যের বিরুদ্ধে দেশে সর্বপ্রথম প্রাণ দিয়েছে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার আত্মত্যাগে দেশের ছাত্র-জনতা জেগে উঠেছিল। পতন হয়েছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের। প্রধান উপদেষ্টা রংপুর সফরে এসে বলেছেন রংপুর হবে এক নম্বর জেলা। অথচ উপদেষ্টা নিয়োগে উত্তরবঙ্গ থেকে কোনো উপদেষ্টা রাখা হয়নি। ফলে বিগত দিনের মত বর্তমানেও উত্তরবঙ্গ বৈষম্যের শিকার। এখানকার মানুষের সমস্যাগুলো তুলে ধরে কাজ করার মত মানুষ নেই উপদেষ্টা পরিষদে।’
নতুন উপদেষ্টা নিয়োগে যে দুটি বিতর্ক উঠেছে, তার মধ্যে প্রথমটির মধ্যে রাজনৈতিক অভিলাষে বিতর্ক তৈরির পরিবেশ থাকলেও দ্বিতীয়টি সর্বাংশে সত্য ও বাস্তব। উত্তরবঙ্গের পরিচয়ের দিকে যদি আমরা তাকাই একটা শব্দই পাবো- ‘পিছিয়ে পড়া ও মঙ্গাপীড়িত’। সেখানে বড় কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। কৃষিশ্রমিক আর রিকশাশ্রমিক হওয়াই নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে উত্তরবঙ্গের মানুষের। শিক্ষার প্রসারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে অনেক পরে, সেটিও অপ্রতুল ও অবহেলিত। সমস্ত পরিসংখ্যানেই সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা এই জনপদের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে নতুন সরকারে। যে প্রতিনিধি সত্যিকার অর্থে উত্তরের জনপদের দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরবেন। তাদের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ ও নীতি জরুরি তা তুলে ধরবেন।
রংপুরে গণঅভ্যুত্থানকারী ছাত্ররা আকতার হোসেনের নাম নিয়েছেন। আমরা জানি, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের বড় অংশটি ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির’। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি ডাকসুর সাবেক সমাজবেসা সম্পাদক আকতার হোসেনের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া সংগঠন। বর্তমানে সেটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। আকতার উত্তরবঙ্গের মানুষ। আকতার ছাড়াও উত্তরবঙ্গে অন্তত এমন অনেক নাম নেওয়া যাবে যারা দীর্ঘসময় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছেন। তারা উত্তরবঙ্গের মানুষের মূল সমস্যাকে চিহ্নিত করতে পারবেন। প্রথম বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে গেলেও আমার মনে হয় দ্বিতীয় বিতর্কটিকে গুরুত্বসহকারে নিতে হবে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে উত্তরবঙ্গের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
গণতান্ত্রিক যাত্রায় পিছিয়ে থাকা বিশাল একটা অংশের মানুষের প্রতিনিধিত্বকে অস্বীকার করে আমরা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারবো না। অগ্রসর হলেও সেটি পূর্ণ গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা বলে মনে করতে পারি না। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান বাংলাদেশ আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে; আমরা একটা বিরাট স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছি। যদি সরকারের গণআকাঙ্ক্ষাকে প্রতিষ্ঠার সদিচ্ছা থাকে তাহলে সেটি বাস্তবায়নও সম্ভব। বর্তমান সরকারের প্রতি সকল রাজনৈতিক দল ও দেশপ্রেমিক জনগণ এখনো তাদের সমর্থন পূর্ণমাত্রায় জারি রেখেছে। গণতান্ত্রিক এই যাত্রায় উত্তরবঙ্গকে সঙ্গে নিয়েই এগোতে হবে।
কেকে/এমআই