দিরা
আমাদের ঘরে পাখির সংখ্যা বাইশ। এই যেনো শুভ সংখ্যা আমাদের জীবনে। সকাল-বিকেল রোজ ওদের খাবার দেই। যত্ম করি ওদের। মাঝে-মধ্যে মাটির সরায় পানি দিয়ে ওদের ছোট্ট সুইমিংপুল করে দেই। ওরা হাসতে হাসতে ডুবতে থাকে, ডানা ঝাপটায়, প্রিয়তমার ঠোঁটে-ঠোঁট মিলায়। সুখ স্মৃতি নিয়ে ওদের ঝিমিয়ে পড়া দুপুর কাটে। কোন কোন দিন অবশ্য অন্য রকম, ওরা প্রচুর ঝগড়া করে। কখনো চাকতি’র ঝুলানো সাদা চক নিয়ে, কখনও সাথীর অভিমানী মন নিয়ে আবার কখনও সন্তান জন্মের আগে আলাদা ঘর নিয়ে। ওদের চিৎকারে এমনও হয় যে, ঘরের লোকদের কান থেকে রক্ত ঝরে যায়। আমরা পিতা-মাতাকে আলাদা ঘরে রাখি, যেনো নব-জন্মের আনন্দের প্রতীক্ষায় থাকি। আবারও শান্ত হয়। বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিলো এভাবে নীল-সবুজ-হলুদ-শুভ্র পাখিদের দিন আর রাত।
সর্বংসহা
স্রষ্টা জানেন রহস্যে মোড়ানো দুনিয়াতে কেনো তোমাকে আর আমাকে পাঠিয়েছেন। অ্যাডাম এবং ইভের গল্প অহরহ বলে গেছে সকলেই আর আমি তো সেই দৃশ্যের বাইরে থেকেছি। তাই আদিতে সৃষ্টি রূপে সূক্ষতম সংযোজক হিসেবে সুর কে খুঁজেছি। বাতাসেরও সুর আছে, গাছেদেরও সুর আছে। স্রষ্টাও শিস দিয়ে সুর তোলে, প্রকৃতির গতিবিধিকে পরিবর্তন করে দেয়। অথচ আমরা সকলেই দু’টো দেহের গল্প খুঁজে যাই। যাদের পরাগে ধ্বনিত হয় উৎসব। ভূ-কম্পণের থেকেও অধিক কম্পন নিয়ে জন্ম নেয় নতুন প্রাণ। ইভ’কে দেয়া যতো অপবাদ সেগুলো কি মিথ্যে নয়? এমন প্রশ্ন করেনি কেউ! সত্যটা কেউ প্রকাশ্যে আনেনি কখনও। একক ঈশ্বরের গ্রামে মৃদু-আলো শুধু এর আসল গল্প জানে। বাতাস আর ছায়া পরস্পরকে অতিক্রম করতেই তারা দু’জন ছিটকে পড়ে, দুই মেরুর এক-পৃথিবীতে।
ক্ষান্তি
শহরের এতো ট্রাফিক, দূর পথে যেতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। খুব জার্নি হচ্ছে সারাদিন। রক্ত-ঘাম যেনো একাকার হচ্ছে তবুও থেমে নেই অ-বিকল যন্ত্রের শরীর। অঙ্গে-অঙ্গে এখন অন্য রকম জাগরণ। ঠিক মা-পাখিটির মতো। মনে মনে ভেবে যাই খুব কি ক্ষতি হতো পাখি হয়ে জন্মালে? কেউ এসে যত্ম করতো, খেতে দিতো প্রিয় সব খাবার। কিচ্ছুটি আর খেতে ইচ্ছে করে না আমার। যা খেতে চাই তা যেনো হিতে-বিপরীত। হঠাৎ একদিন বারান্দায় তাকিয়ে দেখি মা-পাখি বাচ্চাটিকে আহত করেছে, ক্ষত-বিক্ষত তার দেহ। আঁতকে উঠে তাকে বের করে নিজের কাছে নিয়ে রাখি। হালকা গরম জলে বেসন গুলিয়ে খাইয়ে দেই। শোচনীয় শরীর, শুনেছি ক্যালসিয়ামের অভাব হলে পাখিরা আঘাত করে তাদের নব-সন্তানের শরীর। কি বীভৎস লাগে ভাবতেই। ছোট্ট নবজাতক পাখি; টেবিল ল্যাম্পের লাইটের হিটে সারারাত তাকে ওম দিয়ে রাখি। এই যাত্রায় বেঁচে গেলে মা-পাখিকে ক্ষমা করে দিবো, এমন ভাবনায় দুলতে থাকি।
বিভূতি
গত ছুটির দিনে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি। অজানা কোথাও নয়, নিকটবর্তী ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দী করেছি। মনে হচ্ছিলো সব এসপার-ওসপার করে একটা উপায় যেনো বেরিয়ে আসে, তাই মনে মনে ঈশ্বর-কে বলেছি শক্তি দিতে। তিনি এই কেমন শক্তি দিলেন আমাকে, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি! রাতে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর, ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখি; আমার সবুজ চোখের সন্তানকে। আমার চোখের মনিতে তার সবুজ মনি তাকিয়ে ডেকে ওঠে ‘মা’, আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। হঠাৎ পেটের নিচ থেকে তিরতির এক যন্ত্রণা শুরু হতে থাকে। দেয়াল হাতড়ে একাই বাথরুমে ঢুকে পড়ি, তারপর সারা শরীর জুড়ে বয়ে গেলো লোহিত সমুদ্র। ফেনা-ফেনা লোহিত সমুদ্রে আমি ডুবে যেতে থাকি, নিভে যেতে থাকে হার্টবিট। পুরো সাদা টাইলসের মেঝেতে ভেসে যাচ্ছে সব, একদলা রক্ত মাখানো ছাই যেনো হাতের ভেতর মুঠোবন্দী। আমি তা নিয়ে বসে থাকি আর ফ্ল্যাশ করে ফেলি লোহিত রক্তের বন্যা। পানির ট্যাপ ছেড়ে দেই যেনো সাদাজলে সব মুছে যায় দ্রুতই। কখন রাত থেকে ভোর হলো। আজান শুনতে পেয়ে আমি বেরিয়ে আসি, প্রভাত ফুটতে দেখি একা-একা। আমার শ্বাস আটকে আসে। একটা ফোন আসে বাড়ি থেকে। ওপ্রান্ত থেকে জানায় আমাদের বাইশ জোড়া পাখি সারা রাত ডানা ঝাপটিয়ে গেছে, একবারও থামেনি। কাউকে ঘুমাতে দেয়নি এক ফোঁটাও। খাঁচার ভেতর শুধু মরে গেছে, ছোট্ট নবজাতক পাখিটা। আমি আর শব্দ খুঁজে পাই না, আর শুনতে পাইনি কিছুই। সব আলোকিত হলে শুধু মনে হতে থাকে, এই কেমন ঐশ্বর্য্যের শক্তি আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে রক্ত-নোনা জলে। আমার পাখির কথা মনে পড়ে, আমার পাখির ডাকনাম দিয়েছিলাম; শ্রুতি। সে পৃথিবী থেকে পাখি হয়ে উড়ে গেছে স্বর্গে। শ্রুতি যদি জানতো পাখি হয়ে উড়ে গিয়ে সে সত্যিই বেঁচে গেছে, এই ঠকে যাওয়া আর আহাজারির জীবন থেকে। শ্রুতি ছোট্ট ছানা আমার, খুব কষ্ট পেয়েছিস? ও পাখি যদি জানতিস, আমিও কুঁকড়ে যাচ্ছি কতো ব্যর্থতায় ডুবে গিয়ে, মুক্তি মেলে না রে...।
কেকে/এমআই