রাজশাহীর গোদাগাড়ী এলাকার যুবক সোহেল রানা। জীবিকার সন্ধানে অবৈধপথে ভারত গিয়েছিলেন। ফেরার পথে মারা গেলেন ভারত সীমান্তে। তার মরদেহ মিলল শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার গারো পাহাড়ের দাওধারা এলাকায়। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে তারই তিন সঙ্গীকে। তবে এটা হত্যা নাকি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু এ নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রশ্ন। সোহেল রানা রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী চর আমতলা গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে।
সূত্র জানায়, জীবিকার সন্ধানে প্রায় ৪ বছর আগে সোহেল রানাসহ চারজন দালালের মাধ্যমে অবৈধপথে ভারতের বেঙ্গালুরুতে গিয়েছিলেন। তাকে ভারত যেতে সহযোগিতা করে স্থানীয় দালাল সুমন। ফেরার পথে ভারত সীমানায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান সোহেল রানা (২১)। বাঁচানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে সঙ্গীরা নালিতাবাড়ী উপজেলার দাওধারা পাহাড়ি এলাকায় লাশ ফেলে পালিয়ে যায়। তবে পুলিশ বলছে, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ছাড়া কিছুই বলা যাবে না।
জানা যায়, সোহেল রানাসহ ভারতে গিয়ে একই এলাকার সাঈদ মাসুম বাবু(২১), মোমিন ওরফে মিন্টু(২৭) ও নাজমুল হকের(২০) সঙ্গে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে। কয়েক বছর সেখানে শ্রম বিক্রি করতে পারলে বেশ কিছু টাকা জমানো যায়। এই লোভে পড়েই গোদাগাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী কয়েক গ্রামের মানুষ ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে অবৈধপথে ভারতে পাড়ি জমায়। সম্প্রতি অবৈধভাবে বসবাসকারী এক যুবক ভারতীয় পাসপোর্টের মাধ্যমে ভিসা সংগ্রহ করে দুবাই পাড়ি জমায়। একইভাবে আরেক যুবক দুবাই যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে বিষয়টি সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে পড়ে। তারা অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করা বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। বিশেষ করে গোদাগাড়ী সীমান্ত পথকে কড়া নজরদারিতে রাখে। এ অভিযানে অনেকে গ্রেফতারও হয়।
তাই সোহেল রানাসহ ৯ জন যুবক দালালের মাধ্যমে শেরপুরের নালিতাবাড়ী সীমান্ত দিয়ে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বেঙ্গালুরু থেকে রওনা হয়। নানা যানবাহনে তিন দিনের পথ পাড়ি দিয়ে তারা গত ২০ অক্টোবর নালিতাবাড়ী সীমান্তের কাছে আসে। রাতের আঁধারে চোরাই সীমান্ত পথ অতিক্রম করার সময় সোহেল রানা ভারতীয়দের পাতা বৈদ্যুতিক ফাঁদের জিআই তারে জড়িয়ে পড়ে। এসময় অপর সহকর্মী নাজমুল তাকে উদ্ধার করতে গেলে সেও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়। পরে তাদের অপর সঙ্গীরা দুজনকেই উদ্ধার করে নালিতাবাড়ী সীমান্ত দিয়ে দাওধারা কাঁটাবাড়ি এলাকার পাহাড়ে প্রবেশ করে। এসময় নাজমুল কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও সোহেল রানা মারা যায়। এদিকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলে ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে সঙ্গীরা তার লাশ ফেলে পালিয়ে যায়। তবে মৃত্যুর খবরটি তারা মোবাইল ফোনে সোহেল রানার বাড়িতে জানায়।
পরে ২১ অক্টোবর সকালে পাহাড়ে গরু চড়াতে গিয়ে রাখালরা লাশ দেখতে পান। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য শেরপুর মর্গে পাঠায়। এদিকে মোবাইল ফোনে খবর পেয়ে সোহেল রানার স্বজনরা নালিতাবাড়ী থানায় যোগাযোগ করেন এবং রাতে সোহেল রানার চাচা টুটুল অজ্ঞাতনামা আসামি করে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে র্যাব সন্দেহভাজন হিসেবে ১৮ নভেম্বর রাতে গোদাগাড়ী উপজেলার চর কনাপাড়া গ্রামের মো. সানাউল হকের ছেলে মো. মমিন ওরফে মিন্টু, মো. সাঈদ মাসুম ওরফে বাবু ও উত্তর কনাপাড়া গ্রামের কালাম মিয়ার ছেলে নাজমুল হককে গ্রেফতার করে নালিতাবাড়ী থানায় নিয়ে আসেন।
গ্রেফতারকৃতরা জানান, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে শ্রমের মজুরি বেশি। তারা সেখানে গিয়ে রাজমিস্ত্রি, জোগালি কিংবা ওয়েল্ডিং মিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করেন। সেখানে তাদের মাসে কমপক্ষে ২২ হাজার টাকা আয় হয়। কয়েক বছর শ্রম বিক্রি করতে পারলে, সঞ্চয়ের টাকায় দেশে একটা কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ অবৈধ পথ বেছে নেয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নুরল আমিন জানান, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত এটি হত্যা না বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু তা বলা যাবে না। আমরা হত্যা মামলার ওপর ভিত্তি করেই আইনি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। ইতোমধ্যেই র্যাবের সহায়তায় গ্রেফতার হওয়া তিনজনকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। অধিকতর তদন্তের জন্য আদালতে গ্রেফতারকৃতদের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
কেকে/এজে