প্রতি বছরের ন্যায় এবারেও বিশ্বব্যাপী ১৮-২৪ নভেম্বর “বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সচেতনতা সপ্তাহ” পালিত হচ্ছে। এ পর্বটি ২০১৫ সালে “বিশ্ব এন্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ” নামে "Antibiotics: Handle with Care" প্রতিপাদ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল। এ বারের প্রতিপাদ্য, Educate, Advocate, Act now! যা সময়ের সাথে শতভাগ সংগতিপূর্ণ। এটি সংকট নিরসনে টেকসই সমাধানের পথনির্দেশ করে। জ্ঞানার্জন, সাহসী পদক্ষেপের জন্য প্রচারণা এবং এই মূহুর্তে কাজের দিকনির্দেশনা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ঘোষিত সবচেয়ে মারাত্মক দশটি স্বাস্থ্য ঝুঁকির একটি হচ্ছে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স।
দেহের গাঠনিক একক কোষ, তবে এর সংখ্যার প্রায় ১০গুন অণুজীব (মাইক্রোঅর্গানিজম, M) মানুষ ও প্রাণীদেহে বাস করে। এমনকি এদের বিস্তৃতি পরিবেশের সর্বত্র যার পরিধি ব্যাকটেরিয়া থেকে ভাইরাস, পরজীবী ও ছত্রাক পর্যন্ত। আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো এগুলোর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আমাদের উপকার করে থাকে। যেমন- ব্যাকটেরিয়াগুলোর মাত্র ৫% প্যাথোজেনিক অর্থাৎ রোগ সৃষ্টি করে। আর মানুষ বৈচিত্র্যময় চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে আসছে যার মধ্যে রয়েছে অভিজ্ঞতামূলক ঔষধ প্রয়োগ থেকে শুরু করে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড ঔষুধ যা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল (AM) নামে পরিচিত। যে জীবাণুর উপর কার্যকরিতা দেখায় তার উপর ভিত্তি করে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল-এর নামকরণ করা হয়ে থাকে যেমন, ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিভাইরাল, ছত্রাক বা ফাংগাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং পরজীরী বা প্যারাসাইটের বিরুদ্ধে অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক। ওষুধের কার্যকারিতায় অণুজীব মারা যায় বা বাধাগ্রস্থ হয়, ফলে, আমরা সুস্থতা অনুভব করি। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, একসময়ের অত্যন্ত কার্যকরী ঔষধ এখন ততটা কার্যকর নয়। অণুজীবগুলো সময়ের সাথে সাথে ঔষধের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন করেছে যাকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR) বলা হয়। এই প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জীবাণুকে 'সুপারবাগ' বলা হয়।
প্রকৃতপক্ষে, মানুষ বা প্রাণী নয় বরং অণুজীবগুলো ঔষধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন এবং ইউরোপীয় সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল এর যৌথ কমিটি রোগতত্ত্বের (এপিডেমিওলজী) ভিত্তিতে রেজিস্ট্যান্ট অণুজীবগুলোকে তাদের রেজিস্টেন্টের মাত্রার উপর ভিত্তি করে তিন ভাগে ভাগ করেছে; মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট, এক্সটেনসিভ ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট, এবং পেন-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট।
মূলত ২০১৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকেই বিষয়টি বহুল আলোচিত। তবে, আমাদের বর্তমান ধারণার বিপরীতে AMR পৃথিবীর প্রাচীনতম সমস্যাগুলোর একটি। ১৯২৮ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কার এবং ১৯৪১ সালে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতকরণের পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪২ সালে পেনিসিলিন-রেজিস্ট্যান্ট স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস পাওয়া যায়। এমনকি, মেথিসিলিন এবং সেফটাজিডিম-অভিব্যাকটাম ঔষধ বাজারজাতকরণের বছরেই এগুলোর প্রতিরোধী জীবাণু পাওয়া গেছে। অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে ব্যবহৃত কার্বাপেনেমসহ চিকিৎসায় 'শেষ অবলম্বন' হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া রিজার্ভ গ্রুপের ঔষধের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধ ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্ব কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের স্টক ফুরিয়ে যাওয়ার পথে। অনুজীবগুলো এন্টিব্যাকটেরিয়াল ছাড়াও এন্টিভাইরাল, এন্টিফাংগাল ও অন্যান্য ঔষধের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবে, রেজিস্ট্যান্ট সক্ষমতা অর্জনে ব্যাকটেরিয়া তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী পারদর্শী।
চিকিৎসার প্রয়োজনে যখন অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রয়োগ করা হয়, তখন কিছু অণুজীব বিভিন্নভাবে এর প্রভাব এড়িয়ে যেতে এবং প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন করে। যেমন- মিউটেশন: ব্যাকটেরিয়ার প্রজননের সময় স্বাভাবিকভাবে বা পরিবেশগত প্রভাবে প্রতিরোধী জিন পেতে পারে যা প্রয়োগকৃত ওষুধগুলিকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম। জিন স্থানান্তর: জীবাণু প্লাজমিড দ্বারা তাদের জিন বিনিময় করতে পারে এবং প্রতিরোধী জিন স্থানান্তর হতে পারে। এনজাইম: কিছু জীবাণু এনজাইম তৈরির মাধ্যমে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালকে নিষ্ক্রিয় করে। প্রতিযোগিতা: প্রতিরোধী জীনসম্পন্ন জীবাণুগুলি সাধারণত অন্য জীবাণুর চেয়ে শক্তিশালী। দৈহিক পরিবর্তন: কিছু অণুজীবগুলো বাহ্যিক গঠনগত বা জৈবরাসায়নিক পরিবর্তিনের মাধ্যমে এন্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। তবে, এন্টিবায়োটিকের খেয়ালি প্রয়োগ এই ভয়াবহতাকে ত্বরান্বিত করছে। যেমনঃ ভাইরাস জাতীয় সংক্রমণে এন্টিবায়োটিকের প্রেসক্রিপশন যা অপ্রয়োজনীয়। গবেষনায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন চীনের উহানের হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের হার ৯৫% যেখানে মাত্র ৫.৬% রোগীর ব্যাকটেরিয়া সংক্রমন ছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রোগ নির্ণয় ছাড়াই অনুমানভিত্তিক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণও এর অন্যতম কারণ। এছাড়াও নিম্নমানের ওষুধ যা অকার্যকর, ভুল প্রেসক্রিপশন, দুর্বল প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, যেমন টিকা, স্যানিটেশন ও জৈবনিরাপত্তা, এবং সরকারের যথাযথ নজরদারি অভাব এর জন্য দায়ী। আমাদের নিত্যদিনে ব্যবহার্য এন্টিসেপটিক ও হ্যান্ড সেনিটাইজারেও কিছু অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ক্ষমতা আছে, যা রেজিস্ট্যান্স অর্জনে ভূমিকা রাখছে।
দূর্ভাগ্যবশত, ভৌগলিক ও আর্থসামাজিক কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এলাকাটি বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। আমাদের নিয়ম-কানুন থাকলেও বাস্তবায়নের হার অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, অ্যান্টিবায়োটিক যেকোন ফার্মেসীতে এমনকি ভ্যারাইটি স্টোরগুলোতেও ওভার-দ্য-কাউন্টার (OTC) ওষুধ হিসাবে কেনা যায়। অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, অন্যদের সাথে অ্যান্টিবায়োটিক শেয়ার করা, চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই পরবর্তী অসুস্থতার জন্য অবশিষ্ট ওষুধ গ্রহণ করা, অনৈতিক চিকিৎসা অনুশীলন যেমনঃ রেজিস্টার্ড চিকিৎসক না হয়েও প্রেসক্রিপশন করা। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চারটি মৌলিক ধরনের অংশীদার- ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানী, মধ্যস্বত্তভোগী গোষ্ঠী, প্রেসক্রেপশনকারী এবং ওষুধ প্রশাসন-সংস্থাগুলোর মধ্যে সমণ্বয় বেশ দুর্বল যাতে করে তথ্য সরবরাহের অভাব, নজরদারি ঘাটতি, ও অ্যান্টিবায়োটিকের যতযত্র ব্যবহার জটিলতর হচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে AMR-এর বিস্তৃতি জনস্বাস্থ্যকে আজ মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলেছে। ২০১৯ সালে সরাসরি ১,২৭০,০০০ জন এবং পরোক্ষভাবে ৪,৯৫০,০০০ জন মানুষের মৃত্যুতে জড়িত ছিল AMR. যা ২০৫০ সাল নাগাদ ১০,০০০,০০০-তে পৌঁছাতে পারে। যখন একটি জীবাণু অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স অর্জন করে, তখন তার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন বা অসম্ভব হয়ে পড়ে অর্থাৎ এটি বিশ্বকে অ্যান্টিবায়োটিক-পুর্ব যুগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত।
অণুজীবগুলোর দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে, ছড়িয়ে পড়ে এবং নতুন নতুন সংক্রমন করে। ফলে, হাসপাতালে থাকার মেয়াদ ও চিকিৎসা খরচ বৃদ্ধি পায়। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির উৎপাদনশীলতা কমে যায়। সর্বোপরি, ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উপর ক্রমবর্ধমান চাপ জাতীয় উৎপাদনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে এবং বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতিতে রুপ নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে, চিকিৎসা খাত অভূতপূর্ব উন্নয়ন করলেও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় মানুষ সে হারে সুফল পাচ্ছে না। উল্লেখ্য যে, ক্যান্সারে মৃত্যুর প্রায় ৮.৫% ক্ষেত্রে প্রকৃত কারণ সেপসিস (পচন) যা অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা নিয়ন্ত্রণ সম্ভবপর হত যদি AMR না থাকত। অ্যান্টিবায়োটিক সঠিকভাবে কাজ না করায় মেজর সার্জারিগুলো যেমন-অঙ্গ প্রতিস্থাপন, জয়েন্ট প্রতিস্থাপন ও সিজারিয়ান সেকশন আজ কঠিন হয়ে পড়েছে। ঔষধবিদ্যা ব্যাখ্যানুসারে, আমরা যে ঔষধ খাই তার শতভাগ দেহে শোষিত হয় না। একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেহের বর্জ্য হিসেবে পরিবেশে অপসারিত হয়।
এছাড়াও, হাসপাতালের জীবাণুমিশ্রিত বর্জ্য পানিতে মিশে রেজিস্ট্যান্স জীবাণুর বিস্তৃতি ঘটায়। অ্যান্টিবায়োটিক রেসিডিউ প্রক্রিয়ায় কিছু অ্যান্টিবায়োটিক প্রাণিজ আমিষের মাধ্যমে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির দেহে স্থানান্তরিত হয় এবং খাদ্য শৃঙ্খলে চলে আসে। চক্রাকারে প্রভাবান্বিত করে বন্যপ্রাণী, গবাদিপ্রাণী এবং প্রকৃতিকে যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। গুরুত্বপূর্ণ হল, বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধির যৌথ নীলনকশা হিসাবে গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-তে উল্লিখিত ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৬টি ঘনিষ্টভাবে এবং ৬টি আংশিকভাবে সম্পর্কিত। এছাড়াও, ২৩২টির মধ্যে ৯০টি অর্থাৎ প্রায় ৪০% সূচক এর সাথে সম্পর্কিত। বিশেষ করে, লক্ষ্য ৩: সুস্বাস্থ্য এবং ভাল থাকা, অনেকাংশেই সম্পর্কিত যা ওয়ান হেলথ স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ৯৫% প্রতিনিধিত্ব নির্দেশ করে। এছাড়াও লক্ষ্য-২: ক্ষুধামুক্ততা, লক্ষ্য-৬: বিশুদ্ধ পানি ও পরিচ্ছন্নতা, লক্ষ্য-৯: শিল্প, উদ্ভাবন এবং অবকাঠামো, লক্ষ্য-১২: দায়িত্বশীল ব্যবহার ও উৎপাদন এবং লক্ষ্য - ১৭: অংশীদারিত্বের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। তাই, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এসডিজি অনেকাংশেই মুখ থুবরে পড়বে।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের সমাধানে যেমন প্রয়োজন আইন ও নীতি প্রণয়ন তেমনি প্রয়োজন সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। অবিলম্বে কার্যকরি পদক্ষেপের মাধ্যমে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের দায়িত্বশীল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। রেজিস্টার্ড ডাক্তার ব্যতীত কেউ যেন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে না পারে এটি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক নির্বাচনের সময় সঠিকভাবে রোগ বা জীবাণু নির্ণয় করতে হবে। ফার্মেসীগুলোতে প্রেসক্রিপশন ব্যতীত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বিক্রি বন্ধ করতে হবে এবং নজরদারির মাধ্যমে তা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। ঔষধ প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিতভাবে ঔষধ প্রয়োগ যেমন-যে ঔষধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন করেছে তা নিদির্ষ্ট মেয়াদে বন্ধ রাখলে পুনরায় সেই জীবাণুর সংবেদনশীলতা ফিরে আসে যা গবেষণায় প্রমাণিত। মানুষস্বাস্থ্য, প্রাণিস্বাস্থ্য, কৃষি এবং পরিবেশকে অন্তর্ভুক্ত করে ওয়ান হেলথ স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে টীকা উৎপাদন ও যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে।
ইতোমধ্যে, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মাল্টি পার্টনার ট্রাস্ট ফান্ড (AMR MPTF), গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ (GARDP) এবং AMR অ্যাকশন ফান্ড এটি নিয়ে কাজ করছে। WHO ২০২৫ সালের মধ্যে পাঁচটি রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর চিকিৎসার উদ্ভাবন ও প্রয়োগের লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। WHO বিশ্বব্যাপী আবিস্কৃত অ্যান্টিবায়োটিকগুলোকে AWaRe (Access, Watch and Reserve) এই তিনটি গ্রুপে ভাগ করেছে। Access-হচ্ছে যে কোন সময়ে রেজিস্টার্ড ডাক্তারগণ প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবেন, Watch-হচ্ছে প্রয়োজন এবং পরীক্ষার ভিত্তিতে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং Reserve-হচ্ছে বিশেষ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য।
জনস্বাস্থ্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হওয়ার সত্ত্বেও SDG-এর লক্ষ্যমাত্রা বা সূচক কোথাও AMR বিষয়টি সরাসরি উল্লেখ করা হয় নি। তাই, AMR ইস্যুতে SDG হলনাগাদ করা সময়ের দাবী। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ছাড়া সত্যিকারের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞগণ এবং রাজনীতিবিদদের যোগাযোগ বাড়ানো উচিত। বিশ্বের কিছু অংশে এখনও পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির অভাব। পানি, স্যানিটেশন এবং হাইজিন হল প্রাথমিক স্বাস্থ্যের মৌলিক অংশ। বিশ্বের নিম্ন আয়ের দেশগুলোর সমস্যা সমাধানে উন্নত বিশ্বের এগিয়ে আসা উচিত। অন্যথায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গড়ে ওঠা AMR সহজেই উন্নত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ AMR ইস্যুটি নিয়ন্ত্রণের সাধ্যমত চেষ্টা করছে এবং বেশ কিছু কার্যকরি পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। ২০১১ সালে “জয়পুর ঘোষণাপত্র-২০১১” স্বাক্ষরের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ন্ত্রণে যাত্রা শুরু করে। এরপর, ২০১২ সালে স্তরভিত্তিক ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটি, ন্যাশনাল টেকনিক্যাল কমিটি এবং ন্যাশনাল ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে ৩টি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে।
১. National Strategy for Antimicrobial Resistance Containment (AMRC): এর লক্ষ্য বহুপাক্ষিক উদ্যোগের মাধ্যমে AMR নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা প্রণয়ন, সমন্বয় এবং বাস্তবায়ন, মানুষ, প্রাণী ও কৃষিতে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের বিচক্ষণ ব্যবহার, সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, জৈব-নিরাপত্তা সম্প্রসারণ, নজরদারি ব্যবস্থার উন্নতি, গবেষণা এবং শিক্ষা।
২. National Action Plan on AMR Control: WHO কর্তৃক গৃহীত গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান (GAP) এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে এটি তৈরী করা হয়েছে। গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস-এর মাধ্যমে মানসম্পন্ন ঔষধ উৎপাদন, নজরদারি এবং সচেতনতার মাধ্যমে গুণগত মান নিশ্চিত করা।
৩. National Surveillance System and Laboratory Network: এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি) অনুসারে AMR সংক্রান্ত পরীক্ষা ও সমন্বয়ের জন্য একজন ফোকাল পারসনের মাধ্যমে দশটি জাতীয় পরীক্ষাগারের একটি নেটওয়ার্ক।
WHO-এর প্রযুক্তিগত সহায়তার অধীনে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর হেলথ সিকিউরিটি (NAPHS)-তে AMR ব্যাপকভাবে স্থান পেয়েছে।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) বাংলাদেশে AMR সনাক্তকরণের জন্য একটি পরীক্ষাগার চালু করেছে। BARA (বাংলাদেশ এএমআর রেসপন্স অ্যালায়েন্স) প্রতিরোধকে প্রশমিত করার জন্য ফিজিসিয়ান এবং ভেটেরিনারিয়ানদের একটি যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যারা নিজেরা অ্যান্টিবায়োটিকের সচেতন ব্যবহারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং সমাজে সচেতনতার কাজ করে যাচ্ছে।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের যত্রতত্র ব্যবহার সীমিত করার জন্য টেকসই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বাংলাদেশ সরকারের উচিত প্রশিক্ষণ, সেমিনার এবং সিম্পোজিয়াম আয়োজন করা। রেডিও, টেলিভিশনে ও অন্যান্য বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনগনকে সচেতন করা। এক্ষেত্রে, স্থানীয় নেতা, বেসরকারি ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগানো যেতে পারে। একটি টেকসই ডাটাবেস তৈরি করা উচিত যেখানে মানব স্বাস্থ্য, প্রাণিস্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশ বিভাগের প্রবেশাধিকার থাকবে। এছাড়াও, প্রযোজ্যক্ষেত্রে, হালনাগাদকৃত তথ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীজনদের মধ্যে শেয়ার করা যেতে পারে। AMR সম্পর্কিত সকল আইন ও বিধি সবাইকে কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। মনিটরিং ও মূল্যায়ন জোরদার করতে হবে।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের ব্যবহার যত বেশি হবে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স তত বেশি হবে। সুতরাং, আমাদের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের ব্যবহার যথাসম্ভব সীমিত করে বিকল্প পদ্ধতিতে চিকিৎসায় মনোযোগ দিতে হবে। ১৭৯৬ সালে এডওয়ার্ড জেনারের আবিস্কৃত টীকাপদ্ধতি আজও মানব ও অন্যান্য প্রাণীর রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত সফলভাবে কাজ করছে। টীকার ব্যাপক প্রয়োগ অন্যতম একটি সহজ, লাভজনক ও প্বার্শপ্রতিক্রিয়াহীন বিকল্প। বর্তমানে, বেশ কিছু টীকার গবেষণা পাইপলাইনে আছে। টীকা উদ্ভাবনের উপর বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তাসহ সকল ধরণের সহযোগিতা জোরদার করা উচিত। সম্প্রতি, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ অনেক রোগ চিকিৎসার জন্য আলো ব্যবহার করে থাকে যা ফটোডাইনামিক থেরাপি নামে পরিচিত। মাল্টিপল ড্রাগ থেরাপি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর তবে তা বিচক্ষণতার সাথে ব্যবহার করতে হবে। ব্যাকটেরিওফেজ ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে খেয়ে ফেলে সংক্রমণ সীমিত রাখতে অবদান রাখে। এছাড়াও, সম্পূরক খাদ্য হিসাবে প্রোবায়োটিক ও প্রিবায়োটিক নিয়মিত গ্রহণ পৌষ্টিক নালীর স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে অবদান রাখে যা বিপাক, শক্তি উৎপাদন এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। এছাড়াও, অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটা ট্রান্সপ্লান্ট অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়া এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে স্থানান্তর করা একটি ভাল উপায়।
শেষকথা, AMR একটি বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য সংকট। স্বাস্থ্যসুরক্ষা ও নানামুখী ক্ষতি কমাতে সকল অংশীজনের দায়িত্বশীল ও খাতভিত্তিক অবদান রাখা অত্যাবশ্যক। শান্তি ও উন্নয়নের নীলনকশা SDG সংশোধন করা প্রয়োজন। জৈবনিরাপত্তা, টীকা, পরিচ্ছন্নতাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সচেতনতার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার বিবেচনা করা। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের ওষুধের গুণগত মাণ বজায় রাখা, দায়িত্বশীল ব্যবহার, আইনের যথাযথ প্রয়োগ অত্যাবশ্যকীয়। গবেষণার মাধ্যমে নতুন এন্টিবায়োটিক ও টীকা আবিস্কার জোরদার করতে হবে। একই সাথে, বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স নিয়ন্ত্রিত হবে এবং জনস্বাস্থ্য উন্নত হবে।
কেকে/এমআই