বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫,
১৭ মাঘ ১৪৩১
বাংলা English

বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫
শিরোনাম: যুক্তরাষ্ট্রে হেলিকপ্টার-বিমান সংঘর্ষে ১৮ মরদেহ উদ্ধার      কাল থেকে শুরু বিশ্ব ইজতেমা, তুরাগ তীরে দলে দলে আসছেন মুসল্লিরা      যুক্তরাষ্ট্রে হেলিকপ্টার-যাত্রীবাহী বিমান সংঘর্ষ, বহু হতাহতের শঙ্কা      জনজীবন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বস্তি ফেরাতে ব্যর্থ সরকার      বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার: তিন নাম বাদ দিয়ে তালিকা প্রকাশ      অস্তিত্ব মেলেনি হাসিনাকন্যা পুতুলের ‘সূচনা ফাউন্ডেশনের’      স্বতন্ত্র চলচ্চিত্র মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি চলচ্চিত্রের অংশীজনদের      
সাহিত্য
নসিব ক্ষ্যাপার জীবনযাপন
শিলু হোসেন
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪, ২:০২ পিএম  (ভিজিটর : ১৭৬)
ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

মোমিনপুর স্টেশন থিকা ঢাকাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ছাড়বে রাত দুইটায়। মধ্য ডিসেম্বরের কড়া শীত উপেক্ষা কইরা এক ঘণ্টা আগেই পৌঁছায়ে গেছি। মাঠের মাঝখানে ছোট স্টেশন চত্বরটা ফাঁকা। চারদিক আন্ধকার। যাত্রীরা তখনও স্টেশনে পৌঁছায় নাই। লাল ইটে গাঁথা পুরান স্টেশনে দুইটামাত্র কক্ষ। একটাতে টিমটিম কইরা আলো জ্বলতেছে। মাথাসহ পুরা শরীরে চাদর জড়ায়া সেই কক্ষে ঝিমাইতেছে একজন স্টেশন মাস্টার। ‘ঝিঁ ঝিঁ’ ডাকতেছে। মাঝে মাঝে কয়েকটা জোনাক পোকা টিমটিম করে আলো জ্বালাতে জ্বালাতে উড়ছে এদিক সেদিক। আমি প্ল্যাটফর্মে আইসা দাঁড়াইতেই একটা কুত্তা শোয়া থিকা উইঠা ঘেউ ঘেউ ডাকে চত্বরের নীরবতা ভাইঙা গেছিলো। এরপর পাশে ঘুর ঘুর করতে থাকল কিছুক্ষণ। পাত্তা দিলাম না ইেখা ঘাড় এদিক-সেদিক ঘুরাইয়া মাটি শুঁকতে শুঁকতে চইলা গেলো। আমার কাঁন্ধের ব্যাগটা ঝুলতেছে অনেকক্ষণ। একটু ব্যথা পাইতেছি। কিন্তু ব্যাগটা বাড়তি ওমও দিচ্ছিল। সেইটা নামালে ঠান্ডা আরও বেশি লাগে কিনা এই ভয়ে না-নামানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। হুডির দুই পকেটে দুই হাত ঢুকাইয়া চুপচাপ দাঁড়ায়ে আছি আর ঘুটঘুটা আন্ধার রেললাইনের দিকে নজর ফেইলা নানান কিছু ভাবতেছি। এছাড়া কিছু করারও নাই!

ট্রেন লেট কিনা জানা রকার। তেমন কাউকে দেখছিও না আশপাশে। আবার স্টেশন মাস্টারের ঘুমানো দেইখা তার কাছে গিয়া জিজ্ঞাস করতেও মন চাইতেছে না। যে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ায়ে আছি, সেইখানে কিছু দূর পর পর তিনটা কংক্রিটের ছোট বেদি সবই কুয়াশায় ভিজে আছে।

শীতে জইমা যাইতেছি। সময়ও যেন জইমা গেছে, নড়াচড়া নাই। স্টেশনে আসার মিনিট বিশেক হয়ছে। যাত্রী আসা শুরু করছে এক-দুজন কইরা। এক বৃদ্ধকে দেখলাম, বস্তা মাথায় নিয়া কাঁপতে কাঁপতে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেছে। তাকে এক পলক দেইখা আবার নজর ফিরাইলাম রেললাইনের দিকে। সেই একই ঘুটঘুটা আন্ধার। টেনশন হইতেছে, ট্রেন লেট হইলে এই ঠান্ডায় স্টেশনে কীভাবে থাকব। এর মধ্যে পাশে ধপাস শব্দ হইলো। আচমকা ঘুইরা দেখি, সেই বৃদ্ধ মাথা থিকা বস্তা ফেইলা আমার বাম পাশে দাঁড়ায়ে দাঁত বাইর কইরা হাসতেছে। এই শীতেও ঘামতেছে সে। মাজায় বান্ধা গামছাটা খুইলা একটা বাড়ি দিয়া ঝাইড়া মুখটা মুইছা নিয়া কইলো, ‘বাবাজি কি ঢাকায় যাবা?’ আমি তার স্য গামছায় মোছা সাদাপাকা দাড়িভর্তি হাস্যোজ্জল মুখটার দিকে তাকায়া জবাব দিলাম, ‘জি চাচা। আপনি কোথায় যাবেন?’

‘আমি কুথাও যাবো না। আমার মেয়ি-জামাই যাবে। উগের রাকতি আসিছি। ওই যে উরা আসছে।’

আঙুল উঁচায়ে মায়া-জামাইরে দেখাইলো বৃদ্ধ। মায়াটার বুকে সন্তান জড়ানো। খুব হাসিখুশি হাঁইটা আসতেছে স্বামীর সঙ্গে। তাদের পিছন পিছন আরও দু-চারজনকে আসতে দেখলাম। সবার হাতেই বস্তা-ব্যাগ। এখনও প্রায় আধাঘণ্টা পর ট্রেন আসবে। সময় কীভাবে কাটানো যায় তা ভাবলাম। কজন আসছে, তা গুইনা দেখা যাইতে পারে। মনে মনে গুইনা দেখলাম আমিসহ ৯ জন। এর মধ্যে দুই শিশু ও তিন নারী।

লোক গুনাগুনি শেষ হইতেই বৃদ্ধ তার মায়ার কোল থিকা শিশুটারে নিয়া আমার মুখোমুখি আইসা দাঁড়াইলো।

আরে আমার নানু আজ ঢাকায় চইলি যাবে, আবার কবে আসবা? আমাক ভুলি যাবা না তো? ন্যাকা ন্যাকা গলায় এমন নানান কথা বইলা শিশুটারে আদর করতেছে। জানতে চাইলাম, ‘নাতি না নাতনি?’ বৃদ্ধ জবাব দিলো, ‘নাতনি গো বিটা। চাইর মাস বয়াস। উর বাপ ঢাকায় চাকরি করে। জন্মের পর এই পোরথোম ঢাকায় যাচ্ছে। আমাদের চুয়াডেঙায় খুব জার পড়িছে। ঢাকা শহরে নাকি জার কম, তাই পাঠি দিচ্ছি। আমাগের ইচ্ছা আর কডাদিন মেয়ি-নাতনি থাকি যাক।’

সে আরও কথা বলতে যাইতেছিল, এর মধ্যে বাচ্চাটা নইড়াচইড়া কান্না জুড়লো। বৃদ্ধ তারে মায়ের কোলে দিতে গেলো। আগের জায়গায় ফিরা আসলো দ্রুতই। ততক্ষণে কুয়াশায় ভেজা একটা বেদি মুইছা তার মায়া-জামাই বইসা পড়ছে। বাচ্চার কাপড় বদলাইতে ব্যস্ত তারা। বৃদ্ধ হাসতে হাসতে কইলো, ‘হিসু কইরি দিছে! ছোট মানুষ, কী আর করা!’

তার গায়ের সোয়েটারটা ভিইজা গেছে। গামছা দিয়া একটু মোছার চেষ্টা করতেছে। কিন্তু ততক্ষণে পানি শুইষা নিছে মোটা সোয়েটার। আমি কোথায় যাবো, কী করি জানতে চাইলো বৃদ্ধ। কইলাম, ‘আমি এই তো পাশেই নীলমনিগঞ্জে আমার বন্ধুর বাসায় বেড়াতে আসছিলাম। ফিরে যাচ্ছি। ঢাকায় ছোটোখাটো চাকরি করি।’ বৃদ্ধ শুইনা কইলো, ‘আলহামদুলিল্লাহ। বাঁইচি থাকো বাপ। আমার মেয়ির জামাই সরকারি চাকরি করে। বেতন মাশাল্লাহ ভালো। মেয়ি আমার সুখিই আছে।’

সদালাপী বৃদ্ধ। ভাবলাম, তার সঙ্গে কথা বইলা কিছু সময় কাটানো যাবে। কিন্তু ১টা ৪৫ বাইজা গেছে, তবু ঘণ্টা বাজায়নি স্টেশনের কেউ। ট্রেন আসার অন্তত ১৫ মিনিট আগে ঘণ্টা বাজানোর কথা। পাশ দিয়া হাঁইটা যাইতে যাইতে কেউ একজন বিরক্তির সুরে বইলা উঠলো, ‘টেন লেট। আসতি আসতি আড়াইটি বাজবে। শালার এই শীতির রাতিই টেন লেইট! আগে জানলি লেপের মোদি আরেট্টু ঘুমি আসতি পাত্তাম।’

তার মুখে লেপের কথা শুইনা শীত যেন গায়ে সূচ ফুটানোর ব্যা দিলো। ট্রেন লেটের খবরে যেন চিন চিন করে উঠলো বুকের ভেতরটা। যে আশঙ্কা করছিলাম, সেটাই হইলো। যাক, কী আর করা। বিষয়টি মাইনা নেওয়া ছাড়া গতি নাই। নিজের সঙ্গে এইসব আলাপ করতেছি আর স্টেশন চত্বরে বসা, দাঁড়ানো লোকজনদের দেখতেছি। কেউ গল্পে মগ্ন, কেউ বিড়ি টানতেছে, কেউ হিসাব কইরা দেখতেছে তাদের বগিটা কোন বরাবর আইসা দাঁড়াইতে পারে; ব্যাগ-বস্তা কোন জায়গায় রাখলে তোলা সুবিধা হবে। তাদের কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে হঠাৎ কানে ভাইসা আসলো, ওপাশের প্ল্যাটফর্ম থিকা কিছুটা দূরে কেউ একজন গলা ছাইড়া গান গাইতেছে ‘একবার আল্লাহ বলো রে, আরে ও দয়াল আল্লাহ গো, হা আ আয় আয়।’ আন্ধারের ভিতর কোনোকিছুর চিহ্ন নাই। কে গান গায়!  মনে হইলো সে স্টেশনের দিকেই আগায়ে আসতেছে। ধীরে ধীরে তার গলার আওয়াজ বাড়তেছিল। অন্তরাটুকু গাইয়া যখনই স্থায়ী অন্তরা ‘একবার আল্লাহ বলো রে, আরে ও য়াল আল্লাহ গো, হা আ আয় আয়’ অংশটাই টান দিতাছে, মনে হইতেছে কেউ মারা গেছে, তার স্বজন বুক চাপড়াইয়া আহাজারি করতেছে। সুরটার ভিতর কেমন এক মায়াভরা আর্তনা। আমি ও বৃদ্ধ লোকটা তার আসার পে চাইয়া থাকলাম। মিনিট তিনেকের মধ্যে সে উদয় হইলো। গান থামাইলো ওপাশের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছেই। পরনের সাদা লম্বা শার্ট, পাঞ্জাবিও হইতে পারে, সেটা চাদরের নিচ থিকা বাইর হয়া আছে। গলায় কালো মাফলার। পায়ে স্পঞ্জের সেন্ডেল। ক্লিন শেভ করা লোকটারে চিনতে পাইরা পাশ থিকা বৃদ্ধ হাঁক দিলো, ‘কী রে নসিব ক্ষ্যাপা, এই জারের রাতি কনতি আসলি?’

নসিব ক্ষ্যাপা রেললাইনে নাইমা পাথর মাড়ায়ে এপাশে আসতে আসতে জবাব দিলো, ‘কোচাগাছায় গিয়েলাম চাচা, গাজীর গান শুনতি। ১২টার দিকি আসর ভাইঙলো। ভাবলাম একেনে আর থাইকি কী কইরবো। চাইড্ডি মাছ-ভাত খায়ি হাঁটা ধরলাম।’

কথাগুলো বলতে বলতে প্ল্যাটফর্মের কাছাকাছি আইসা পড়লো নসিব ক্ষ্যাপা। তার দিকে এক হাত বাড়ায়ে টাইনা তুললো বৃদ্ধ। এরপর দরদের সহিত হাতে হাত রাইখা কইলো, ‘ইশ, তোর হাতটা কী কালা হয়ি গিছে! এই শীতি ঘুইরি বেড়াচ্ছিস কীভাবে!’

‘আজ এক মাস বাড়ি ছাড়িছি। দুই বিগি ভুই ধান লাগি দুই ছেলিকে বুঝি দি আসিছি। একুন আমার ঘুরাঘুরির সময়। যে দেশ ইচ্ছা চইলি যাবো। ধান কাটার আগে আগে আবার বাড়ি ফিইরবো।’

নসিব ক্ষ্যাপার আচরণ, কথাবার্তা আমারে দ্রুতই আকর্ষণ করলো। বৃদ্ধ তার কাছে জানতে চাইলো, ওদিককার খেঁজুর গাছ কি কাটিছে? রস-টস কিরাম হচ্ছে?

‘গাছে গাছে তো ভাড় বান্ধা দ্যাখলাম। রস কিরাম হচ্ছে বুলতি পারিনি। এ বছর খেঁজুরই রসই তো একুনু চাইখি দ্যাখলাম না।’

রসের কথা উঠতেই দুই চোখের ভ্রু কাঁপিয়ে রসিকতার ছলে নসিব ক্ষ্যাপা গাইয়া উঠলো- ‘যি রস খাবি রে নলিন দানা, গাছে ভাড় বেঁধে দে না, বেঁধে দে না, গাছে ভাড় বেঁধে দে না, বেঁধে দে না।’

এ তো দেখি কথায় কথায় গান! কোচ থিকা বাইর কইরা একটা বিড়ি মুখে ধরলো নসিব। বুক পকেট হাতড়াইয়া দিয়াশলাই পাইলো। সেইটা খুইলা চেইতা উইঠা কইলো, ‘আরে বাড়া ম্যাচটা কিনতিই ভুইলি গিছি! এখন এই দুইটা কাটিতি রাইত পিটাইতে হবে!’ ম্যাচ না নেওয়ার নিজের অপরাধে নিজের ওপর বিরক্ত সে। তার অপরাধবোধ দেইখা কাঁন্ধের ব্যাগ নামায়া সাইড পকেট থিকা লাইটার বের কইরা তার দিকে বাড়ায়ে দিয়া কইলাম, ‘এইটা নেন।’

লাইটার পায়া খুব খুশি নসিব। সেটা দেইখা হাতেই রাইখা দিলো। কাছে থাকা শেলাইয়ের কাঠি জ্বালানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু ‘ফিচ’ কইরা একটু জ্বইলা নিইভা গেলো। আর একটা কাঠিই ছিল। মুখ দিয়া ‘হা হা’ কইরা সেটা একটু গরম কইরা নিয়া দেশলাইয়ের বক্সে ঘষা দিলো। চড়বড় শব্দে জ্বইলা উঠলো আগুন। সেইটা তালুতে ঢেকে মুখটা আগায়ে বিড়িটা জ্বালাইলো। এরপর লম্বা এক টান দিয়া ধোঁয়া ছাইড়া আমারে কইলো, ‘নিজির সাতে এট্টা গেম খেললাম। মনে মনে বুললাম, এই কাটি যদি না জ্বালাতি পারি আইজ রাতিই বাড়ি ফিরি যাবো। কিন্তু মালিকির কী ইশারা, জ্বইলি গেলো। হা হা হা!’

তার হাসি থামলে জানতে চাইলাম, আপনি কি প্রায়ই বাড়ি থেকে এভাবে বেরিয়ে পড়েন?

হ্যাঁ গো বাপ। বছরে দুই বার ধানের আবা করি। ধানের চারা লাগিই বাড়িত্তি বেরাই। দুই ছেলি আছে, বউ আছে তারাই সেচ দেয়, সার দেয়, যত্ন করে। আমি ধান কাটার আগে আগে বাড়ি হাজির হয়ি যাই।

সংসার ছেড়ে এভাবে কয়েক মাসের জন্য বেরিয়ে পড়েন, বাড়ির লোকজন রাগ করে না?

আমার এই বেড়ানির রোগ সেই জুয়ান কালেততি। ১৩ বছর বয়াসে বাপ মইরি গেলো। ভাবলাম, জলজ্যান্ত একটা মানুষ এভাবে পটাস কইরি মইরি কন চইলি গেলো! এই জীবনের মানেডা কী তাহলি? ইরপর আস্তে আস্তে জাগতিক বিষয়তি আমার মন উটতি থাইকলু। ছোটা দুই ভাইর বিয়ে-সাদির পর আমি বিয়ে করলাম। কিন্তু আমার তো উড়ার স্বভাব। প্রথম প্রথম বউ খুব রাগ কইত্তু। তাই ধান লাগানির পরই তাকে বাপের বাড়ি রাইকি আসতাম। বাপ-ভাইরা আবা দেইখতু। তারা এট্টু রাগারাগি কইত্তু আগে। কিন্তু আমার কিছু করার নি। ঘরে বেশিদিন মন টেকে না বাপ।

ঢং ঢং ঘণ্টা বাইজা উঠলো। পকেট থিকা হাত বাইর কইরা ঘড়ি দেখলাম। ২টা ৫ বাজে। তার মানে আর ১৫ মিনিট পর ট্রেন আসবে। নসিব ক্ষ্যাপার কথা শুনতে শুনতে ভালোই সময় কাটছিল। যাত্রাপালার অভিনেতাদের মতো সুরে সুরে কথা কয় সে। আর একটু পর পর গান গাইয়া ওঠে।

জানতে চাইলাম, আপনি কি যাত্রাপালায় অভিনয় করেন?

না, যাত্রা করিনি। তবে কুনু জাগায় গান হলি আসরে বইসি পড়ি। এই আশপাশ ইলাকায় যত গানের লোক আছে সবাই আমাকে চেনে। আমি জুড়ি নিয়ে আসরে বইসি যাই। মেইন শিল্পীর সাথে দুহার দিই। এতেই আমার আনন্দ।

আপনার গানের গলা খুব সুন্দর।

এই শকের বশে এট্টু গাই আর কী।

আজ রাতে আপনি কোথায় যাবেন?

আমার নিদ্দিষ্ট কুনু গন্তব্য নি। তবে একটা কতা বুলি বাপ, মরণ হইলু আসল গন্তব্য। মালিক সুমায়মতো সে জাগায় রাকপে যেকেনে আমার-তুমার থাকার কথা। এইযি একুন আমি স্টিশনে দাঁড়ি আছি। এটা কি আমার ইচ্ছায়? মানুষির পিলানে কিছুই হয় না। আমি তো ভাবিইনি কোচাগাছা গিরামতি গান শুইনি মোমিনপুর স্টিশনে আইসি তুমার মতো অচীন মানুষির সাথে দেকা হবে, কথা কবো। চাইড্ডি ভাত খাইয়ি এক বান্ডিল বিড়ি কিনি রওনা দিছি। বিড়ি টানতি টানতি গান গাতি গাতি একেনে চইলি আসলাম। একুন আবার হাঁটা ধইরবো, তারপর মালিক যেদিক নিয়ি যায়, সেদিক যায়ি উইডবো।

এত রাতে ঘুরে বেড়াবেন, আপনার ভয় করবে না? আজ রাতটা না হয় স্টেশনেই কাটান। সকালে রওনা দিয়েন।

আমার কথা শুইনা অট্টহাসিতে ফাইটা পড়লো নসিব ক্ষ্যাপা। হাসতে হাসতে কাঁশি চইলা আসলো। গায়ে জড়ানো চাদরের এক কোনা হাতে তুইলা চাইপা ধরলো মুখে। কাশি থামলে বিড়িতে শেষ টান মাইরা অবশিষ্ট অংশ ফালায় দিয়া কইলো, ‘শোনো, সুমায়কে আমি কুনু সুমায় মাপিনি। আমার কাছে কী দিন, কী রাইত, সবই সুমান। ঘুম আসলিই ঘুমাই। ঘুমানি নিয়ি কুনু চাপ নি। মাঠ ধইরি হাঁটতি হাঁটতি যকুন ইেকপো কিলান্তো হয়ি গিছি, তকুনই সেকেনে শুয়ি পইড়বো। ঘুম ভাঙলি হাঁটা ধইরবো আবার। সব গিরামেরই দু-পাঁচজন লোক আমাকে চেনে। কুনু অসুবিধি হয় না।’

নসিবের কথা শুনি আর অবাক হই। কী অদ্ভূতভাবে সে জীবন উদযাপন করে। টাইম ধইরা, হিসাব কইরা চলার এই সময়ে এমন মানুষও আছে! তার সংসার নিয়া চিন্তা নেই। দিনের পর দিন গ্রামের পর গ্রাম ঘুরতেছে। ক্লান্ত হইলে ঘুমায়া পড়তেছে। তাকে কোনো কিছুতে তাগাদা দেওয়ার কেউ নাই। কিন্তু কীসের সন্ধানে রাস্তার পর রাস্তা হাঁটতেছে সে? এমন জীবন উদযাপনের ধরন সে আবিষ্কার করলো ক্যামনে?

এক মুহূর্তের জন্য মনে হইলো তার সঙ্গে আমিও হাঁটা ধরি। কিন্তু সেই সময়েই ‘পু’ শব্দ শোনা গেলো। রেললাইনের দিকে চোখ ফেইলা দেখি, দূরে মৃদু আলো জ্বলতেছে। ধীর ধীরে তা গাঢ় হয়া আগায়ে আসতেছে। একটু পরই ট্রেনে উঠতে হবে। সকাল থিকা শুরু হবে সেই একই জীবন– অফিস-বাসা-অফিস!

গায়ের চাদরটা খুইলা একবার ঝাইড়া নিলো নসিব ক্ষ্যাপা। পরনের লুঙ্গিটাও কইষা বাঁনলো। তখনও গুন গুন গাইতেছে– দিনে দিনে গেলো দিন, বাকি মাত্র কয়েক দিন, একদিনও ভাবলি না ওইদিনের ভাবো না।

আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না। ট্রেন আসতে দেইখা যাত্রীরা নইড়াচইড়া উঠলো। সবাই প্রস্তুত হয়তেছে। আমিও কাঁন্ধের ব্যাগটা ঠিকঠাক কইরা নিলাম। নসিব ক্ষ্যাপা ট্রেন আসার দৃশ্য দেখতেছে। ভাবগতিক দেইখা মনে হইলো, সেও ট্রেনে উইঠা পড়বে। কিন্তু ট্রেন প্ল্যাটফর্মে থামতেই সে একটু সইরা গেলো। দরজার লোহার রডটা ধইরা ট্রেনে উঠতে যাবো, এমন সময় লাইটারটা ফিরায়ে আমার দিকে ধরলো। কইলাম, ‘আপনার কাছে রেখে নে। পরে কাজে লাগবে’। চওড়া হাসি দিয়া হাত তুইলা বিদায় নিলো সে। আমিও হাত তুললাম। তবে বগির ভিতর গেলাম না। দাঁড়ায়ে থাকলাম দরজাতেই। ট্রেন ছাইড়া দিলো। নসিবও স্টেশন চত্বর ছাড়ার জন্য হাঁটা ধরছে। ধীরে ধীরে ট্রেনের গতি বাড়তেছে। কিন্তু নসিব চলতেছে ঢিমেতালে। যেন কোথাও যাওয়ার তাড়া নাই তার। স্টেশন থিকা আরও দূরে সইরা আসল ট্রেন। তখন গাঢ় আন্ধারেও সাদা জামা পরা নসিব ক্ষ্যাপারে দেখা যাইতেছে।

ট্রেনের গতি আরেকটু বাড়ল। আন্ধারে নসিবের চিহ্ন মিলায়ে যাওয়ার আগে ঝক ঝকা ঝক শব্দের ভিতরে ভাইসা আসলো তার রাজ গলা– ওই দিনের আর কয়দিন বাকি, দেহ ছেড়ে যাবে পাখি, দেখবি ওই দিন সবই ফাঁকি, সবই ছলনা...।

কেকে/এমআই
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

কোকাকোলায় পাওয়া গেছে ভয়ংকর ক্ষতিকর রাসায়নিক
সালথায় আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা অনুষ্ঠিত
স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে তিতুমীর শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ
বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ১৪ স্পেশাল ট্রেন
ধনবাড়ীতে জনপ্রিয় হচ্ছে রঙিন ফুলকপি চাষ

সর্বাধিক পঠিত

আপন ভাইকে হত্যা করতে গিয়ে অন্য ব্যাক্তিকে হত্যা: চারজনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সম্মেলন উপলক্ষে গণমিছিল
টঙ্গীতে পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে ছুরিকাঘাতে যুবক খুন
বাঞ্ছারামপুরে হিজড়াদের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ
চাঁদাবাজির ভুয়া অভিযোগে ভালুকা যুবদল নেতাকে শোকজ!

সাহিত্য- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2024 Kholakagoj
🔝